দীর্ঘদিন সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবার প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পড়েছে। এই প্রথম জামায়াতের মতো সুশৃঙ্খল দলটিতে নিজেদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে প্রার্থী মনোনয়ন ঘিরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, দ্বন্দ্ব আর অসন্তোষের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ময়মনসিংহ, পাবনা, কুমিল্লা, সিলেটসহ কয়েকটি আসনে নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, প্রার্থীকে লাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত ঘোষণার মতো কাণ্ড ঘটেছে, যা আগে কখনো ঘটেনি এই দলটিতে।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, একটি সুশৃঙ্খল দল হওয়ায় জামায়াতে রুকন (সদস্য), কর্মী, সহযোগী সদস্য এই তিন স্তর আছে। সংসদ নির্বাচনে দলটিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের ভোটে প্রার্থী বাছাই করা হয়। কেন্দ্র থেকে প্রার্থী অনুমোদন দেওয়া হয়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও জামায়াত দলীয়ভাবে যে প্রার্থীকে সমর্থন করেছে, নেতা-কর্মীরা তাকেই মেনে নেন। বিগত নির্বাচনগুলোতে এভাবে প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। তবে এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। শুধু নরসিংদী-৫ আসনে এখনো কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। মনোনয়ন দেওয়া আসনগুলোর মধ্যে এবার পাবনা-৫ (সদর), ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া), কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে প্রকাশ্য বিরোধ, প্রার্থীকে লাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার মাধ্যমে দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসেছে। এ ছাড়া সিলেট-৫ আসন নিয়েও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জামায়াতে নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা সিরিয়াস কোনো বিষয় নয়। এগুলো করছে একবারে সমর্থক পর্যায়ে। কোনো প্রার্থী এগুলোর সঙ্গে জড়িত নন। তবে আমরা অনুসন্ধান করছি, কোথাও প্রার্থীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। কোথাও যদি সংগঠনও সম্পৃক্ত থাকে, সেখানে সংগঠনও স্থগিত করা হবে। জামায়াত শৃঙ্খলার বিষয়ে খুব কঠোর।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা-৭ আসনে মাওলানা মোশারফ হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াত। এরপরই দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা মনোনীত প্রার্থীকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দেন। তাদের অভিযোগ, মোশারফ হোসেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ। এ নিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়ায় ২৭ অক্টোবর। ওই দিন কেন্দ্রীয় নিদের্শনা অনুযায়ী, পাঁচ দফা দাবির গণমিছিলের সময় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মাওলানা মোশারফ হোসেন বক্তব্য দেওয়ার সময় মাইক কেড়ে নিয়ে জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ ‘দল বিক্রি চলবে না, আওয়ামী দোসর প্রার্থী মানি না’ স্লোগান দেয়। স্থানীয় সূত্র জানা যায়, মোস্তফা শাকেরুল্লাহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। তাকে স্থানীয়দের একটি অংশ প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়। তবে কেন্দ্রীয় জামায়াত সূত্র জানায়, মাঠের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝে কেন্দ্র থেকে মোশারফ হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
পাবনা-৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়া হয় মাওলানা ইকবাল হোসেনকে। তবে গত জুন মাসে ওই আসনের জামায়াতের এমপি প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে পাবনা জামায়াতে ইসলামীর একাংশ। এ সময় তারা সাবেক এমপি মাওলানা আবদুস সুবহানের ঘনিষ্ঠ সহচর মওলানা আবদুর রহিমকে জামায়াতের এমপি প্রার্থী করারও দাবি জানান।
এরপর ময়মনসিংহ-৬ আসনের মনোনয়ন নিয়েও প্রকাশ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলার নায়েবে আমির অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলন। তবে তাঁর নাম ঘোষণার পরপরই জামায়াতের প্রার্থী হতে আগ্রহী জসিম উদ্দিনের সমর্থনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় কামরুল হাসান মিলনকে ফুলবাড়ীতে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেন তারা। যদিও ২০০১ সালে এই আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন জেলা আমির অধ্যাপক জসিম উদ্দিন। এলাকায় তার জনপ্রিয়তাও রয়েছে।
এ ছাড়া সিলেট-৫ আসনে আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী করায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে স্থানীয় জামায়াতে। এর আগে ১৯৯৬ সালে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত জামায়াতের ফরিদউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালে এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এবার তার বদলে আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জামায়াতের পক্ষ থেকে যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তিনি এলাকায় জনপ্রিয় নন।