শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

পোশাকে বর্ণমালা

পোশাকে বর্ণমালা

♦ মডেল : সামির, মাইশা, বৃষ্টি ও রিমু ♦ ছবি : বিশ্বজিৎ সরকার ♦ পোশাক : অঞ্জন’স

ফাল্গুন তারুণ্যের উৎসব, ফাল্গুন তারুণ্যের অনুপ্রেরণা। এই ফাল্গুনের আগুনঝরা রোদে বাংলার দামাল ছেলেরা ইতিহাস রচিত করেছিল মাতৃভাষার নামে। মায়ের ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত ঝরিয়ে ছিল বীর বাঙালি জাতি। সেই অমর একুশে চেতনা শুধু মায়ের ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে আছে বাঙালিয়ানার সংস্কৃতিতেও। একুশের চেতনায় বাঙালি শুধু মায়ের মুখের ভাষাতেই নয়, আপাদমস্তক নিজেকে সাজাতে চায় মাতৃভূমির রঙে-রূপে। তাই তো একুশে পোশাকই হয়ে ওঠে বাঙালির রুচি, চেতনা ও ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা। রক্তের দামে কেনা বর্ণমালার প্রতি বাঙালির চিরঞ্জীব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা রঙে, নানা ঢঙে। কখনো পোশাকে, কখনো উপহারে, কখনো একুশের সংকলনে।

 

একুশের দিনে ফাল্গুনে পোশাকেও থাকে একুশ। কেননা, ফাল্গুন যেমন তারুণ্যের উৎসব, তেমনি জ্বালাময়ী শপথ। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ও বুটিকগুলো তাদের পোশাকে একুশকে প্রতিপাদ্য করে তৈরি করছে নতুন নতুন ডিজাইনের বর্ণমালার পোশাক। রং, কাপড় এবং ডিজাইন সবকিছুতেই ভাষা আন্দোলনের চেতনা। তাই অ আ ক খ বর্ণমালাই যেন তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পোশাক। ফলে পোশাকে বর্ণমালার ব্যবহার যেন বাঙালির চেতনারই অংশ। পোশাকের ক্যানভাসে অক্ষরচিত্র নিয়ে বিভিন্ন রং ও ডিজাইন মোটিভে সেজেছে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো।

পোশাকে ইতিহাস ও ঐতিহ্য

একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের অহংকার। শোক, শ্রদ্ধা ও গৌরবের দিনটির নানা আয়োজনের সঙ্গে একুশের দৃঢ় চেতনা অনেক আগের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ অর্জন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে যেমন গৌরবময় ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, তেমনিভাবে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষাও তার নিজস্ব মহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আর মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই দিনটিকে ঘিরেই থাকে আমাদের নানা আয়োজন। ভাষার প্রতি বাঙালির যে মমত্ববোধ, একুশের মাধ্যমে তা উঠে আসে লেখায়, রেখায় এবং দৈনন্দিন জীবন যাপনে; এমনকি ফ্যাশনের ভুবনেও। একুশের ভাবনার সঙ্গে মিল রেখে পোশাকে বর্ণমালার ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়। আর পোশাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একুশের গান, কবিতা, স্লোগান ও বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন পঙিক্তমালা। যেখানে ফুটে উঠেছে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা গৌরবগাথা। এ ছাড়া শহীদ মিনার, মানচিত্র, পতাকাসহ একুশের বিভিন্ন চিত্রের প্রকাশ ঘটেছে একুশের পোশাকে।

রঙের বৈচিত্র্য

একুশের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে পোশাকের পসরাতে বিভিন্ন দোকান ও বুটিকগুলো তৈরি করছে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক। এসব পোশাকে ব্যবহৃত রং, কাপড়, ডিজাইন সবকিছুতেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনের ছোঁয়া। সাদাকালো রঙে শহীদদের প্রতি শোক আর ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। তবে, এখন আর তা দুটি রঙের মধ্যে আটকে নেই। একুশ এখন সেজেছে সর্বজনীন রঙের বৈচিত্র্যে। তাই রঙের ব্যবহারেও রয়েছে নানা ফিউশন। সাদা, কালো, লাল, সবুজ, হলুদ, নীল তামাটেসহ সব রঙেই সেজেছে একুশের পোশাক। কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির প্রাধান্য থাকলেও তাঁত, মসলিন, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবহারও বাড়ছে।

নকশা ও পোশাকের ধরন

একুশে পোশাকের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গর্বিত বর্ণমালার মালার সাজ। একুশের কালেকশন মানেই বাংলা অক্ষরের ব্যবহার। সেলিব্রেটি কিংবা আমজনতা যাই হোন না কেন, এই দিনে বর্ণমালার পোশাক ব্যাপারটাই যেন গর্বের ব্যাপার। একুশের আয়োজনে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে ছেলেদের জন্য থাকছে নানা রঙের টি-শার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, চাদর এবং মেয়েদের জন্য থাকছে ফতুয়া, টপস, সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি। শিশুদের জন্যও রয়েছে নানা আয়োজন। এসব পোশাকের জমিনে নানা রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলা ভাষা ও আন্দোলনের ইতিহাস। একুশের পোশাকের নকশায় বর্ণমালা, ভাষা ও ভাষাশহীদদের পাশাপাশি দেশজ চেতনা ও ঐতিহ্যের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই তো নকশিকাঁথা ফোঁড়, ব্লক, স্প্রে-ব্লক, অ্যাপলিক, ক্যাটওয়াক, স্ক্রিন, হ্যান্ডপেইন্ট, অ্যামব্রয়ডারির কাজ চোখে পড়ার মতো। প্যাটার্ন ভেরিয়েশনে থাকছে ট্রেন্ডি এবং ডিজাইনে করা হয়েছে দেশীয় ঐতিহ্য।

একটা সময় ছিল ফাল্গুন আর একুশের আয়োজনে মেয়েদের প্রথম পছন্দ ছিল শাড়ি। সাদাকালো কিংবা নীলের পটভূমিতে একুশের বর্ণমালাকে ধারণ করা মেয়েদের শাড়িতে সুতির প্রাধান্যই বেশি। এসব শাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে মসলিন, সুতি, তাঁতসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এ ছাড়া সালোয়ার-কামিজে সাদাকালোর প্রচলিত ধারা বদলে যুক্ত হয়েছে ধূসর, সাদা-লাল, কালচে সবুজ ও তামাটে রং। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্লক, স্ক্রিনপ্রিন্ট, ঘন বুনোটের অ্যামব্রয়ডারি, নানা রঙের সুতার নকশার ব্যবহারে সালোয়ার-কামিজের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আধুনিক তরুণীরা চুড়িদার বা সালোয়ারের সঙ্গে কলার ফুল ও হাফ স্লিভ পোশাকগুলো পরতে পারেন একুশের আয়োজনে। বর্ণমালার সাজে ছেলেদের পাঞ্জাবিতেও করা হয়েছে বিভিন্ন রকমের ডিজাইন।

সাদাকালোর কম্বিনেশনে করা হয়েছে মানচিত্র, উক্তি, কবিতা ও অক্ষরমালা। কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির প্রাধান্য থাকলেও তাঁত, মসলিন, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবহারও কম নয়। প্রতিটি পোশাকে একুশের স্মারক হিসেবে রয়েছে বর্ণমালার প্রতি ভালোবাসা। এ ছাড়া নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একুশের অন্য যে অনুষঙ্গগুলো যোগ হতে পারে পরিধেয়র সঙ্গে তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় মেয়েদের মাথা আর গলায় গাঁদা ফুলের সাজের কথা। সঙ্গে ছোট-বড় সবার গালে রংতুলির ছোঁয়ায় জন্ম নেওয়া বর্ণমালা আর একুশের মিনারও যেন সবাইকে মনে করিয়ে দেয় অমর একুশে ফেব্রুয়ারির কথা।

 

একুশের উপহার

নতুন প্রজন্ম একুশকে কেবল চেতনাতেই ধরে রাখেনি, ছড়িয়ে দিয়েছে জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বর্ণমালা ব্যবহারকে নতুনত্ব দিতে প্রতিটি শো-পিস ও গিফটহ্যাম্পারে আনা হয়েছে বর্ণমালার সাজ। একুশের পোশাকের পাশাপাশি মগ বা ক্ষুদ্র অনুষঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে বাঙালির ভালোবাসার ভাষা। ছোট্ট ছোট্ট চাবির রিংয়েও প্রিয় বর্ণমালা ধারণ করে করা হয়েছে অসাধারণ। বইমেলার বইয়ের ভালোবাসা তো বাঙালির জন্য পরম উপহার। একুশের এসব ছোট্ট উপহারের পসরা সাজিয়েছে আড়ং, অঞ্জন’স, হলমার্ট, আর্চিজ গ্যালারির মতো দোকান।

 

স্বদেশ প্রেম জাগুক প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ, বয়স্ক নির্বিশেষে সবাই মিলে মাতৃভাষা দিবসকে উদযাপন করবেন। তাই তো বিশেষ এই দিনটিকে ঘিরে বাঙালির পোশাকে থাকছে বর্ণমালার প্রতি ভালোবাসার ছোঁয়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর