২৫ নভেম্বর, ২০২০ ১০:৫৭

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে কি চাপে পড়েছে পাকিস্তান

অনলাইন ডেস্ক

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে কি চাপে পড়েছে পাকিস্তান

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে টিভিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কিছু বক্তব্য নিয়ে সপ্তাহ-খানেক ধরে দেশের ভেতর এবং বাইরে তুমুল চর্চা চলছে।

পাকিস্তানের বেসরকারি জিএনএন টিভি চ্যানেলে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ইমরান খান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে পাকিস্তানের ওপর চাপ রয়েছে।

“আমেরিকায় ইসরায়েলের গভীর প্রভাব রয়েছে যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় আরো বেড়েছে ... চাপটা সেখান থেকেই।“

মধ্যপ্রাচ্যের “ভাতৃপ্রতীম“ মুসলিম দেশও কি পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে - এমন প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও তা সামলে ইমরান খান উত্তর দেন, “সব কথা সব সময় বলা যায়না। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো।“

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে কেউ কি পাকিস্তানকে কোনো লোভ দেখাচ্ছে ? - এই প্রশ্নে বিব্রত ইমরান খান উত্তর দেন, “বাদ দেন এসব প্রশ্ন, অন্য কথা বলেন। আমাদের দেশ যখন নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে, তখন এসব প্রশ্ন করবেন।“

তবে পরপরই ইমরান খান বলেন, ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ বিকিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরি নিয়ে তিনি ভাবছেন না। “যতক্ষণ না ন্যায়সঙ্গত এমন কোনো মীমাংসা হয় যা ফিলিস্তিনিদের মন:পুত হয় ততক্ষণ আমার ভেতর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই।“

অবশ্য সেই সাথে ইমরান খান বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে অনেক সময় আপোষ করতে হয়। তিনি বলেন, নবীও বৃহত্তর স্বার্থে হুদাইবিয়ার চুক্তি করেছিলেন।

এই সাক্ষাৎকার প্রচারের সাথে সাথেই ইমরান খানের এসব কথা নিয়ে পাকিস্তানের ভেতর এবং বাইরে কাঁটাছেড়া চলছে। ইসরায়েলের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কথার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে।

হৈচৈ দেখে সাক্ষাৎকারটি প্রচারের দুদিন পরেই ১৭ই নভেম্বর পাকিস্তানের সরকার এক বিবৃতি জারী করে বলে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে পাকিস্তানের ওপর কোনো চাপ নেই।

সেই মুসলিম দেশ কোনটি

তবে তাতে বিতর্ক আলোচনা থেমে নেই। বিশেষ করে ‘ভাতৃপ্রতীম‘ মুসলিম রাষ্ট্রের কাছ থেকে চাপ তৈরির যে প্রশ্ন ইমরান খান এড়িয়ে গেছেন সেই দেশটি কে হতে পারে তা নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে।

পাকিস্তানের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক কানওয়ার খুলদুন শহিদ ইসরায়েলি দৈনিক হারেতজে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন - চাপ দিচ্ছে এমন যে “ভাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশের নাম ইমরান খান করতে চাননি সেই দেশটি সৌদি আরব।“

কানোয়ার শহিদ বলেন, তাদের ওপর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নির্ভরতার সুযোগ সৌদিরা নিতেই পারে। পাকিস্তানের প্রায় ২০০ কোটি ডলারের জরুরী ঋণ সাহায্য সৌদি আরব আটকে রেখেছে যা পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

ঐ সাংবাদিক আরো লিখেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও ইসরায়েলের সাসথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে কারণ, তার মতে, সেনাবাহিনী মনে করে তাতে ভারত-ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্কে কিছুটা হলেও ভারসাম্য আনা যাবে। সৌদি আরবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর “অর্থনৈতিক স্বার্থের“ কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানী ঐ সাংবাদিক ইঙ্গিত করেন যে সেনাবাহিনীর মাধ্যমেও হয়ত সৌদি আরব ইসরায়েল নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান বদলের চেষ্টা করছে।

কিন্তু এই বিশ্লেষণের সাথে সবাই অবশ্য একমত নন।

পাকিস্তানের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাসান আসকারি রিজভি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সৌদি আরব পাকিস্তানের ওপর এসব স্পর্শকাতর ইস্যুতে কতটা চাপ দিতে পারে তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

বরঞ্চ, তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে, ফলে ওয়াশিংটন যদি এ নিয়ে পাকিস্তানকে কিছু বলে থেকে তাতে তিনি অবাক হবেননা।

“নানা কৌশলগত ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসনের সাথে অব্যাহত কথাবার্তা পাকিস্তানের হয়। সে সব যোগাযোগের সময় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কিছু পরামর্শ, প্রস্তাব আসতেই পারে। এটাকে অনেকে চাপ হিসাবেও দেখতে পারেন ...আমি এতে বিস্মিত নই।“

‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা‘

তবে চাপ বা পরামর্শ যেটাই আসুক তাতে পাকিস্তানের সায় দেয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?হাসান রিজভি মনে করেন পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসরায়েল বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নেওয়া ইমরান খানের জন্য ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা‘ হবে।

“ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে কোনো চাপ বা পরামর্শে নিশ্চিতভাবে ইমরান খান স্বস্তি বোধ করবেন না। এমনিতেই দেশের প্রধান বিরোধ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে থেকে তিনি বড় ধরণের চাপে পড়েছেন। তার ওপর ইসরায়েলকে স্বীকৃতির যে কোনো ইঙ্গিতে কট্টর ইসলামি দলগুলোর যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা সামাল দেওয়া তার জন্য কঠিন হবে।“

রিজভি বলেন, এসব ইসলামি দলগুলো ভোটে না জিতলেও রাস্তায় অরাজকতা তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সক্ষম। “আমি কোনোভাবেই মনে করিনা যে ইমরান খান এখন তেমন বিপদ ডেকে আনতে চাইবেন।“

ইসরায়েল কী ভাবছে?

ইসরায়েলে নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জেরুজালেম ইন্সটিটিউট অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি‘র (জেআইএসএস) গবেষক ড. জনাথন স্পায়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, আরব মুসলিম দুটি দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর ইজরায়েল এখন এ ধরণের সম্পর্ককে আরব বিশ্বের বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে।

“সেই অর্থে পাকিস্তান ইসরায়েলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ তাতে সন্দেহ নেই,“ তিনি বলেন।

কিন্তু একই সাথে ড. স্পায়ার বলেন, “ইসরায়েল এবং ইহুদিদের“ নিয়ে পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল ওয়াকিবহাল।

“এছাড়া, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বা ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানের যে কথা ইমরান খান বার বার বলছেন ইসরায়েল তাতে গুরুত্ব দিতে রাজী নয়। ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। এই নিয়ে পাকিস্তানের স্পর্শকাতরতাকে ইজরায়েল গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয়না।“

ভারতীয় সাংবাদিক হারিন্দার মিস্র ২২ বছর জেরুজালেমে কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, সম্পর্কের সাথে ফিলিস্তিন ইস্যুকে যুক্ত করতে ইসরায়েল এখন আর কোনোভাবেই রাজী নয়।

“এখানে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি মুসলিম বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে ইসরায়েল উদগ্রীব হলেও, মি নেতানিয়াহু এবং ডানপন্থীরা সবসময় এই সম্পর্কের ফিলিস্তিন ইস্যু যুক্ত করতে অস্বীকার করেছে,'' মি. মিস্র বলেন।

''কয়েকটি আরব দেশের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর এখন ইসরায়েলে সবাই বলছে মি. নেতানিয়াহুর নীতিই সঠিক ছিল বলে প্রমাণিত হচ্ছে।“

ভারত এবং তুরস্ক ফ্যাক্টর

ড. স্পায়ার মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের যে কোনো স্পর্শকাতরতা ইসরায়েলের পক্ষে অগ্রাহ্য করা এখন প্রায় অসম্ভব।

“অর্থনৈতিক এবং স্ট্রাটেজিক দিক দিয়ে আমেরিকার পর ভারত এখন ইসরায়েলের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণদেশ। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের চেয়ে ভারতের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া ইসরায়েলের কাছে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।“

সেই সাথে, তিনি বলেন, হালে ইসলামাবাদের সাথে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতার কারণে পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে ইসরায়েল সন্দিহান।

ড. স্পায়ার মনে করেন, ইমরান খান সরকারের ওপর যদি কোনো চাপ তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রধানত আসছে সৌদি আরবের কাছ থেকে, এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে।

“পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমেরিকার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে উদগ্রীব। তারা হয়ত মনে করছে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কথা বললে তাতে সুবিধা হবে,“ ড. স্পায়ার বলেন।

পাকিস্তান নিয়ে আগ্রহ

তবে মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমানবিক অস্ত্রধর পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে ইজরায়েলের আগ্রহ নতুন কিছু নয়।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুশাররফও এতে আগ্রহী ছিলেন। তার ইচ্ছাতেই ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে তৎকালীন ইসরায়েলিপররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলভান শালোমের সাথে পাকিস্তানের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কাসুরির একটি বৈঠক হয়।

কয়েক মাস পরে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে জেনারেল মুশাররফ করমর্দন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারনের সাথে। তাদের মধ্যে আড়ালে কথা হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।

তবে পরে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মি. মুশাররফ ইঙ্গিত দেন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজী হলে পাকিস্তান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত।

ঐ মাসেই পাকিস্তানের ডন পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলভান শালোম বলেন, “ইসরায়েল তাদের ৫৮ বছরের ইতিহাসে কখনই পাকিস্তানকে শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করেনি, এবং ইসরায়েল বিশ্বাস করে ইরান, লিবিয়া বা সিরিয়ার মত পাকিস্তান কখনই ইসরায়েলের ক্ষতি করতে চায়না।“

তিনি বলেন, ইসরায়েল ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করতে চায় বলে যে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব‘ রয়েছে, সেটা ডাহা মনগড়া।

ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালে তার ভারত সফরের সময়ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তার দেশ পাকিস্তানকে শত্রু হিসাবে বিবেচনা করেনা।

কিন্তু ড. জনাথন স্পায়ার মনে করেন ১০ বা ১৫ বছর আগে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে ইসরায়েলের সরকার মহলে যতটা আগ্রহ দেখা যেত, এখন ততটা নেই।

“প্রধান কারণ গত বছরগুলোতে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা।“

পাকিস্তানে জনমত

কয়েকটি আরব দেশের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক তৈরি এবং ইমরান খানের সর্বশেষ সাক্ষাৎকারের পর পাকিস্তানের মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করছেন।

হাসান আসকারি রিজভি বলেন, ইসরায়েল নিয়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরূপ ধারণা থাকলেও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত একটি শ্রেনীর মধ্যে এই ইস্যুতে মতভেদ রয়েছে।

“কেউ কেউ মনে করেন ইসরায়েল এবং ইহুদিদের যেহেতু আমেরিকাতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে সুতরাং তাদের সাথে সম্পর্ক পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য ভালো। আবার কেউ কেউ তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করার পক্ষে।“

মি রিজভি মনে করেন, সৌদি আরব যদি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে পাকিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থীদের একটি অংশ অনেকটাই চুপ হয়ে যাবে। “তখন হয়ত রাজনীতিকদের পক্ষে অন্য রকম কিছু ভাবা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।“

তবে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ও ইজরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্কের কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর