৪ অক্টোবর, ২০২২ ১৩:১৫
ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন

চার বছর পর অবশেষে সফল, দালাল ছাড়াই যেভাবে ইতালিতে পৌঁছান বাংলাদেশি মাহিন

অনলাইন ডেস্ক

চার বছর পর অবশেষে সফল, দালাল ছাড়াই যেভাবে ইতালিতে পৌঁছান বাংলাদেশি মাহিন

আশরাফুজ্জামান মাহিন। ছবি: সংগৃহীত

গোটা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর বহু সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশী সাগর পাড়ি দিয়ে এবং স্থলপথে জঙ্গল পেরিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্তও হয়। আবার অনেকে অপহৃত হয়ে নির্যাতনেরও শিকার হয়।

তবে বাংলাদেশি তরুণ আশরাফুজ্জামান মাহিন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন কোনও দালাল ছাড়াই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু বন্ধু সঙ্গে ইতালিতে পৌঁছেছেন তিনি।

ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তার সেই গল্প।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসী আশরাফুজ্জামান মাহিনের সঙ্গে ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাংবাদিকদের প্রথম দেখা হয়েছিল চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি। তখন বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের একটি শরণার্থী শিবিরে ছিলেন তিনি।

ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাংবাদিকরা আবারেও দেখা পেয়েছেন মাহিনের। তবে বসনিয়ায় নয়, এবার ইতালির সিসিলি দ্বীপের রাজধানী পালেরমোতে পাওয়া গেছে তাকে, গত ২০ সেপ্টেম্বর। 

কিন্তু কীভাবে বসনিয়া থেকে ইতালিতে পৌঁছেছেন মাহিন। আসুন জেনে নেওয়া যাক তার সেই গল্প।

পালেরমোর কেন্দ্রের ব্যস্ত সড়কে স্কুটার দাপিয়ে বেড়ান আশরাফুজ্জামান মাহিন। ২০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাংবাদিকদের দেখে নিজেই স্কুটার থেকে নেমে এগিয়ে আসেন। জানান, বসনিয়াতে দেখা হয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে।

জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা মাহিন বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানালেন, বসনিয়া থেকে স্মার্টফোনে লোকেশন দেখে নিজে নিজেই ইতালি পর্যন্ত চলে এসেছেন তিনি। প্রথমে মিলানে কয়েকমাস কাটিয়ে এখন সিসিলিতে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের এই তরুণ।

ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, “বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়ার জঙ্গল ধরে আমি প্রথমে স্লোভেনিয়া যাই। সেখানে পুলিশ হাতে ধরা পড়ার পর দু’দিন আটকে রাখে। তারপর দেশটিতে সাময়িকভাবে অবস্থানের অনুমতি দেয়। এরপর আমি ইতালি চলে আসি। সব মিলিয়ে ১২ দিন লেগেছে।”

বসনিয়া থেকে ইতালি পৌঁছাতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়েছে মাহিনকে। শুরুর দিকে মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে নিজে নিজেই চেষ্টা শুরু করেন। নিজে নিজে চেষ্টা শুরু করার পর আবারেও বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হন তিনি। পরে ছয়মাস আগে ইতালিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন তিনি।

“আমি বসনিয়া থেকে ইতালি আসতে দালালকে কোনও টাকা পয়সা দিইনি। উল্টো সাথে করে আরেও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছি। সবমিলিয়ে ১৯ জনের মতো ইতালি পৌঁছেছি,” ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন ২৪ বছর বয়সী এই অভিবাসী৷

দীর্ঘচেষ্টার পর ইতালিতে পৌঁছানো

আশরাফুজ্জামান মাহিনের ইউরোপ পৌঁছানোর গল্পটা বেশ লম্বা। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের এই তরুণ অনিয়মিত পথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন সেই ২০১৮ সালে। এজন্য দেশে থাকতেই মানবপাচারকারীদের সহায়তা নেন তিনি।

মাহিন বলেন, “আমি ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ওমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। এরপর ওমান থেকে ইরান যাই। ইরান থেকে এক পর্যায়ে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে পৌঁছাই। এরপর সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া ঘুরে বসনিয়া।”

বসনিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে ছয় লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছিল মাহিনের। দেড় বছরের মতো বলকান দেশটিতে অবস্থান করেছিলেন বাংলাদেশি এই তরুণ। আশ্রয় নেন ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত সংলগ্ন ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের একটি শরণার্থী শিবিরে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বহিঃসীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইতালি বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করা অভিবাসীদের অনেকে শুরুতে এই শহরে অবস্থান নেন। এরপর সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন তারা।

পাকিস্তানি এবং আফগান একদল মানবপাচারকারী অর্থের বিনিময়ে অভিবাসীদেরকে অনিয়মিত পথে ইউরোপে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দেয় বলে জানান মাহিন।

তিনি বলেন, “ভেলিকা ক্লাদুসাকেন্দ্রিক মানবপাচারকারীচক্রের হোতা মূলত পাকিস্তানি এবং আফগানরা। তারা মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করেন এবং তারপর বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।”

তবে, এভাবে ইইউ সীমান্ত পাড়ি দেওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এক ব্যাপার। ক্রোয়েশিয়া পুলিশ অভিবাসীদের নির্দয়ভাবে পিটিয়ে বসনিয়ায় পুশব্যাক করানোর অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় সীমান্তে অভিবাসীদের লক্ষ্য করে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়।

ইনফোমাইগ্রেন্টস অতীতে বসনিয়াতে একাধিক বাংলাদেশি অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছে যারা সীমান্ত বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

মাহিনও অনিয়মিত পথে ইইউ সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়েছেন। তার হিসেবে, ১৫ বারের মতো আটকে দেওয়া হয়েছিল তাকে। ফেরত পাঠানো হয়েছে বসনিয়ায়।

তিনি বলেন, “বেশিরভাগ সময় স্লোভেনিয়াতে গিয়ে আটকে যেতাম।”

ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয়

ইউরোপের দেশ ইতালিতে পৌঁছানোর পর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন আশরাফুজ্জামান মাহিন। তার সেই আশ্রয়ের উপর শুনানি এখনও হয়নি।

তাতে অবশ্য বিশেষ সমস্যায় পড়তে হয়নি তার। মাহিন জানান, ইতোমধ্যে ইতালিতে ছয়মাস কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন তিনি।

“আমি ছয়মাসের কাগজ দিয়ে কাজ করতে পারছি। ছয়মাস পর আবার এটি নবায়ন করতে হবে। এরমধ্যে আমার আশ্রয়ের আবেদনের শুনানির জন্য একটি তারিখ পড়বে। যদি আমার আবেদন গ্রহণ করা হয় তাহলে বছরখানেকের মধ্যে পুরোপুরি বৈধ হয়ে যেতে পারব।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশির অবস্থান ইতালিতে। অনেক অভিবাসীর মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে যে, কোনেওক্রমে ইতালিতে পৌঁছাতে পারলে একসময় বৈধ হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। মাহিনও সেটাই আশা করছেন।

তিনি বলেন, “আমি এখন একটি সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ করছি। সেখানে সুশি বানানো শেখার পাশাপাশি ওয়েটারের কাজ করি।”

রেস্তোরাঁয় কাজ করে সবকিছু ভালোভাবে চলছে বলেই জানালেন এই বাংলাদেশি তরুণ। ইতোমধ্যে ৬৫ হাজার টাকা খরচ করে একটি স্কুটারও কিনেছেন তিনি। সেটি নিয়ে অবসর সময়ে পালেরমো চষে বেড়ান মাহিন।

তিনি বলেন, “আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। ভবিষ্যতে কাগজপত্র হয়ে গেলে নিজেই একটি সুশি রেস্তোরাঁ করার ইচ্ছা আছে। দেশে গিয়েও ঘুরে আসব।”

‘এভাবে আসা ঠিক নয়, বিকল্পও নেই’

মাহিন চারবছর চেষ্টা করে যে পথে বাংলাদেশ থেকে ইতালি পৌঁছেছেন তা অত্যন্ত বিপজ্জনক এক পথ হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ইরান-তুরস্ক সীমান্তে পুলিশের গুলিতে অভিবাসীদের মৃত্যুর খবর শোনা যায় মাঝেমাঝেই। এছাড়া মানবপাচারকারীদের হাতে অভিবাসীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটে সেখানে। অনেক সময় মানবপাচারকারীরা অভিবাসীদের জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা আদায় করে।

মাহিন মনে করেন, এরকম অনিয়মিত পথে ইউরোপে আসা উচিত নয়। তারপরও অনেকে চলে আসেন।

“ইউরোপে কোনও রকমে ঢুকতে পারলেই আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়,” বলেন তিনি। তিনি যোগ করেন, “আমাদের তরুণরা দেশে থেকে তেমন কিছু করতে পারে না। কাজ করার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। লেখাপড়া শিখেও বেকার থাকতে হয়। এজন্যই এভাবে যাত্রা করে।” সূত্র: ডয়েচে ভেলে

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর