২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাটে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই ধুঁকছে পাকিস্তান। খাবি খাচ্ছে বাবর আজমের দল। ঠিক সেই মুহূর্তে অনেকেই খুঁজছেন ১৯৯২ বিশ্বকাপের এক ত্রাতাকে। যিনি ভাঙা-বিপর্যস্ত টিম নিয়েই চূড়া ছুঁয়েছিলেন মেলবোর্নে। পাকিস্তানকে এনে দিয়েছিলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপ।
এমন আলাপের মাঝেই ২২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লো অনলাইন মাধ্যমে। আর তাতেই বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। যে ভিডিওতে দেখা গেল পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক কাপ্তান এবং দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গুলি করছে একজন।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের গুজরনওয়ালার আলওয়ালা চকে একটি ট্রাকে চড়ে ইমরান সমর্থকদের উদ্দেশে লং মার্চে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তখনই আচমকা গুলি চালায় একজন। এতে গুলিবিদ্ধ হন ইমরান খান। জানা যায়, ইমরানের পায়ে একাধিক গুলি লেগেছে।
আর এই গুলিটাও লেগেছে ২০২২ সালে। আবার এ বছরই প্রধানমন্ত্রীর পদ হারান ইমরান খান। সবমিলিয়ে ২২-এর একটা চক্র চলছে ইমরান খানকে ঘিরে।
তবে ২২ৎ-এর চক্র এখানেই শেষ নয়। ইমরান খানে ক্রিকেট ক্যারিয়ারও নানা উত্থান পতনে ঠাসা। সুদর্শন ইমরানকে ঘিরে যেমন নানা গুঞ্জন-সমালোচনা আছে। ক্রিকেটার থেকে যার জুটেছিল প্লেবয় তকমা। তেমন আছে রহস্য আর প্রশংসাও।
সেই ইমরান মূল রহস্যটা জমিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালে। বিশ্বকাপের দলে তিনি অবসর ভেঙে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর যা ঘটেছে, তাতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকেও ছাড়িয়ে গেছেন ইমরান।
ইমরানের পাকিস্তানকে সেই বিশ্বকাপে বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নের তালিকায় রাখেননি। ভারতের কাছে হারের পর দেশেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। পাকিস্তান কোথায় শেষ করবে এই নিয়ে যখন আলোচনা শুরু, তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ইমরান। পাকিস্তানকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে সব সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন তিনি।
ইমরান যখন নেতৃত্ব নেন, তখন পাকিস্তান ক্রিকেটে নানা বিভাজন। দলের মাঝেও ছিল কয়েকটা দল। ক্রিকেটাররা ব্যক্তিগত সাফল্য পেলেও দলগত বড় সাফল্য অধরাই ছিল পাকিস্তানের। ইমরান বুঝতে পারলেন এই বিভেদে একতার সুর চড়াতে না পারলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য আনা সম্ভব নয়। তাই তৈরি করতে হবে দলীয় সংহতি। সাজঘরের পরিবেশ আর আবহ পাল্টাতে হবে।
ইমরান তাই প্রথম থেকেই রাশ ধরেছিলেন শক্ত হাতে। মুখে তিনি যত না কথা বলতেন, তার থেকে বেশি কথা বলত তার ব্যক্তিত্ব, শরীরী ভাষা। ইমরানের উপর কথা বলতে পারতেন না কেউই। ওয়াসিম আকরাম, জাভেদ মিয়াদাদ, সেলিম মালিক, আকিব জাভেদ, আমির সোহেল, রামিজ রাজা, মঈন খান, মুস্তাক আহমেদদের মতো একঝাঁক বিশ্বমানের ক্রিকেটারকে পেয়েছিলেন। তাদেরকেই কাজে লাগালেন ইমরান।
মজার বিষয় হলো, ১৯৮৭ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ভারত এবং পাকিস্তান। সে বার স্বপ্নপূরণ হয়নি ইমরানের। পাকিস্তানকে সেমিফাইনালেই বিদায় নিতে হয় অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে। সেই বিশ্বকাপের পরেই অবসর ঘোষণা করেন হতাশ ইমরান। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিয়া উল-হকের অনুরোধে ফেরেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ইমরানের হাতেই ফের তুলে দেওয়া হয় জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব। ঘরের মাঠে বিশ্বজয়ের অধরা স্বপ্ন ইমরান পূর্ণ করেন পরের বিশ্বকাপেই। সেই অস্ট্রেলিয়ায়, মেলবোর্নে।
সেবার বিশ্বকাপে শুরুতে দলের ছন্দহীনতা, নিজের চোট, সমালোচনা কোনও কিছুই দমাতে পারেনি মিডিয়াম পেসার থেকে ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠা ইমরানকে। ক্রিকেটে রিভার্স সুইংয়ের অন্যতম প্রবর্তক ইমরান ব্যাথা কমানোর ইঞ্জেকশন নিয়েই বিশ্বকাপের একাধিক ম্যাচ খেলেছিলেন। অনেকেই বলেন, সেবার ইমরানের মরিয়া মানসিকতাই বাকিদের অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনিই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিশ্বাস করেছিলেন, ‘আমরাও পারি।’ তাই ফুটেছিল লাল গোলাপ।
আর সেই বিশ্বাসের বসতিতে ক্যারিয়ারের ২২তম বছরে ইমরান খান পান বিশ্বকাপের স্বপ্ন-ট্রফির দেখা। এরপর ইমরান নামেন রাজনীতিতে, ২২ গজ মাতানো ইমরানের সেই পথে সফল হতেও লেগেছিল ২২ বছর। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ২২তম বছরে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রীর পদে আসীন হন। আবার ২০২২ সালেই অনাস্থায় হন পদচ্যুত!
ইমরানের উত্থান পতন, বল-ব্যাট আর বুলেট সবই কাকতালীয়ভাবে ২২ চক্রে আটকে গেছে...
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল