গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা চলে আসছিল, তা কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠক করলেন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকরা। সোমবার বিকালে রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নের সভাঘরে জুনিয়র ডাক্তারদের ১০ দফা দাবি নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা চলে।
বৈঠক শেষে জুনিয়র চিকিৎসকরা জানান, আরজি করের নিহত তিলোত্তমার বাবা-মায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে এবং সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই আমরা আমরণ অনশন প্রত্যাহার করলাম। সেক্ষেত্রে অনশন শুরুর ১৭ দিনের মাথায় এই অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলো। একইসাথে মঙ্গলবার গোটা রাজ্য জুড়ে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে যে সর্বাত্মক স্বাস্থ্য ধর্মঘট শুরু করার কথা ছিল, সেই পথ থেকেও সরে আসছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের এই সিদ্ধান্তে আপাতত স্বস্তি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে।
যদিও এ ব্যাপারে 'ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট' (WBJDF) এর প্রতিনিধি ডা. দেবাশীষ হালদার জানান, ‘লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার রেখেই আমরা অনশন প্রত্যাহার করলাম। তবে আমাদের আন্দোলন চলতে থাকবে।’ আরজি করের ঘটনার সুবিচারসহ বিভিন্ন দাবি পূরণে আগামী শনিবার আরজিকর মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন।
পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী, সোমবার ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে অনশন মঞ্চ থেকে বিকাল ৫টার মধ্যেই নবান্ন চলে আসেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ৪৫ মিনিট। কিন্তু দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি দাবি নিয়ে সেই বৈঠক চরে দু’ঘণ্টা। সোমবারের সেই বৈঠকের পুরোটাই সরাসরি সম্প্রচার দেখেন গোটা রাজ্যের মানুষ। এই বৈঠকে জুনিয়র চিকিৎসকদের কিছু দাবিতে সরকারের পক্ষ একদিকে যেমন সম্মতি জানায়, ঠিক সেভাবেই বেশ কিছু দাবিতে মতানৈক্য দেখা দেয় দুই পক্ষের মধ্যে। এমনও দেখা যায়, বেশ কিছু ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র চিকিৎসকদের রীতিমতো বাদানুবাদ তৈরি হয়।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও সরকারের তরফে উপস্থিত ছিলেন মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্র সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। অন্যদিকে আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দলে ছিল ১৭ জন সদস্য।
একসময় জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে কার্যত অনুনয়-বিনয় করা হয় বৈঠক শেষ করার জন্য। কারণ, এদিন সন্ধ্যায় নবান্নে আরেক নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। অবশেষে সেই বৈঠক থামে সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে।
বৈঠক শেষে জুনিয়র চিকিৎসকরা সোজা চলে আসেন ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে অনশন মঞ্চে। সেখানে নিজেদের মধ্যে জেনারেল বডি (জিবি) বৈঠক করেন তারা। এরপর সংবাদ ব্রিফিংয়ে তারা জানান, আর একটা অভয়া বা তিলোত্তমা যাতে না হয় এই ব্যাপারে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। আরজি করের সাবেক প্রিন্সিপাল ডা. সন্দীপ ঘোষ, ডা. অভীক দে বা ডা. বিরুপাক্ষ বিশ্বাসের মতো মানুষের জন্যই অভয়ার মতন ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ করেন ডা. দেবাশীষ হালদার।
আন্দোলনের অন্যতম মুখ ডা. দেবাশীষ হালদার জানান, আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা নির্বাচনের দাবি ছিনিয়ে আনতে পেরেছি। আগামী বছরের মার্চে মেডিকেল কলেজগুলিতে ভোট হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী কথা দিয়েছেন। এটা একটা জয়। তবে থ্রেট কালচার নিয়ে বলতে গেলে মুখ্যমন্ত্রী রীতিমতো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছেন।
যদিও মমতার সরকারের প্রশাসনের শরীরী ভাষা বা আচরণ সেটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি জুনিয়র ডাক্তাররা। সম্মেলন করে এদিন জুনিয়র চিকিৎসকরা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারের শরীরী ভাষা আমাদের একেবারেই ভালো লাগেনি। আমাদের বুকে যে ‘ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে যে ব্যাজ লাগানো ছিল সেটা পরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এদিনের বৈঠকে জুনিয়র চিকিৎসকদের অন্যতম দাবি ছিল স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকে তার পদ থেকে অপসারণ করা। সেই দাবিকে খারিজ করে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, একটা মানুষের অভিযোগ প্রমাণের আগে তাকে অভিযুক্ত বলা যায় না। আমি এটা লিগাল পয়েন্ট থেকে আপনাকে বলছি। এরপরই অন্য এক জুনিয়র নারী চিকিৎসক পাল্টা জবাব দেন, স্বাস্থ্য সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তাই তিনি একজন অভিযুক্ত, তাকে আমরা অভিযুক্তই বলবো। যখন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হবে তখন তাকে আমরা দোষী বলবো। এটাই ব্যাকরণগতভাবে ঠিক।’
তবে এর আগে একাধিকবার প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও মুখ্যমন্ত্রী ও তার প্রশাসনের সাথে জুনিয়র চিকিৎসকদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। গত মাসেই মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল সেই বৈঠক যেন সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ স্ট্রিমিং) করা হয়। যদিও আইনের দোহাই দিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং-এ রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষের অনড় মনোভাবের কারণে বারংবার ভেস্তে গিয়েছে বৈঠক। তার ফল ভুগতে হয়েছে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে।
এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ অক্টোবর থেকে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে আমরণ অনশনে বসেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। আর এই অনশন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন চিকিৎসক অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পরিবর্তে অন্য চিকিৎসকরা অনশন শুরু করেন। এরই মধ্যে গত শনিবার রাজ্য সরকারকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকরা ঘোষণা দেন, ‘সমস্যা মেটাতে সোমবার পর্যন্ত সরকার যদি কোনো সদিচ্ছা না দেখায়, তবে মঙ্গলবার থেকেই গোটা রাজ্য জুড়ে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ধর্মঘট শুরু হবে।’ এরপরই টনক নড়ে সরকারের। সোমবার সন্ধ্যায় জুনিয়র চিকিৎসকদের সাথে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল