নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিচ্ছেন এমন সব লোকজনকে-যাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিতর্ক উঠেছে খোদ রিপাবলিকান পার্টিতেও। অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকার জন্যে কংগ্রেসের উদ্যোগে তদন্ত হওয়া ব্যক্তিকে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে হাসি-ঠাট্টাকারিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর মনোনয়ন দিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠিয়েছেন ট্রাম্প। প্রকাশ্যে বলাবলি হচ্ছে যে, যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা নয় অনুগতরাই ঠাঁই পাচ্ছেন ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা অথবা হোয়াইট হাউজের গুরুত্বপূর্ণ পদে। এসব মনোনয়নের অনুমোদন নিতে হবে ইউএস সিনেট থেকে। সিনেটরদের অনেকে এ নিয়ে হতবাক।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সংশ্লিষ্ট সেক্টরে অভিজ্ঞতাসম্পন্নদেরকে মনোনয়ন দেয়ার পর সিনেটের মুখোমুখী হতে হয় সে সব ব্যক্তিকে। সিনেট অনুমোদন দিলেই তা চূড়ান্ত হয়ে থাকে। এবারের নির্বাচনে সিনেটেও ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিজ্ঞতা যাচাই না করেই কেবল অনুগতদের নিয়োগ দিয়ে অনেককেই হতবাক করেছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এমন সিদ্ধান্তের কারণে ট্রাম্পের বেশ কিছু মিত্র হতবাক, তুলছেন পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন। তবে তার এই বাছাই প্রক্রিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে, তিনি আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার নিজের মত করে নতুন ভাবে সাজানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিশেষ করে বাইডেন-কমলা প্রশাসন কর্তৃক তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনায় যারা তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন তারাও ট্রাম্প প্রশাসনে ঠাঁই পাওয়ায় সামনের চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি নিয়ে অনেকে অস্থিরতায় নিপতিত হয়েছেন। ‘তাহলে কী ট্রাম্প নিজকে প্রতিহিংসাপরায়ন শাসক’ হিসেবে পরিগণিত করতে চান’-এমন গুঞ্জন সর্বমহলে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ৪২ বছর বয়সী কংগ্রেস সদস্য ম্যাট গেটজকে বেছে নিয়ে অনেককেই অবাক করেছেন ট্রাম্প। কারণ, গেটজের কখনও বিচার বিভাগে কাজ করা বা কৌঁসুলি হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া, তার বিরুদ্ধে যৌনকর্মী পাচারের অভিযোগে বিচার বিভাগ তদন্ত করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি। গেটজ যৌন অসদাচরণ, অবৈধ মাদক ব্যবহার সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের জন্য হাউস এথিক্স কমিটির তদন্তের মুখোমুখিও হয়েছিলেন।
হাওয়াইয়ের সাবেক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান এবং পরে ট্রাম্পের সমর্থক হওয়া তুলসী গ্যাবার্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরবর্তী প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান তুলসী গ্যাবার্ড একজন ইউএস আর্মি রিজার্ভ কর্মকর্তা। তার গোয়েন্দা বিষয়ক গভীর অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি মস্কোর প্রতি তার সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত। ইউক্রেন যুদ্ধে তিনি রাশিয়ার পক্ষ সমর্থনেরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, “আমি জানি তুলসী সেই নির্ভীক মনোভাব নিয়ে আসবেন, আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের রক্ষক হবেন এবং শক্তির মাধ্যমে শান্তি নিশ্চিত করবেন।” তবে ট্রাম্পের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে তুলসীকে বেছে নেওয়াও হতবাক করেছে মিত্রদের। কারণ, সরাসরি গোয়েন্দা কাজে গ্যাবার্ডের অভিজ্ঞতা খুব কমই। তাকে এ পদের জন্য বেছে নেওয়া হবে এমনটি কেউ ভাবেনি। জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে গ্যাবার্ডকে ১৮টি গুপ্তচর সংস্থা দেখভালের নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি ২০০৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত হাওয়াই ন্যাশনাল গার্ডের মেজর হিসাবে ইরাকে মোতায়েন ছিলেন। এখন তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর রিজার্ভে লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
মঙ্গলবার ট্রাম্প তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ফক্স নিউজের ভাষ্যকার ও অভিজ্ঞ পিট হেগসেথকে বেছে নেন। নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে জেনারেলরা প্রগতিশীল নীতি অনুসরণ করে সামরিক বাহিনীর পদগুলোতে বৈচিত্রের প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন মার্কিন বাহিনীকে তাদের থেকে মুক্ত করবেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলরাও সামরিক বাহিনীর এ ‘বৈচিত্রের’ বিরোধিতা করেছেন। রক্ষণশীল হেগসেথও সেই ধারার মানুষ আর তিনি পরবর্তী মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হলে তা ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্ষেত্রে সঠিক নির্বাচন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে এমনটি হলে হেগসেথের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রধান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান, বিমান বাহিনীর জেনারেল চার্লস কিউ. ব্রাউনের দ্বন্দ্ব বাধতে পারে। এজন্যে ট্রাম্পের টিম পেন্টাগণের পদস্থ কর্মকর্তাগণের একটি তালিকা করছেন যারা ২০ জানুয়ারির পর বরখাস্ত হবেন বলে শুক্রবার প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ। এ ধরনের আরো অনেক আমলাকে বরখাস্তের আশংকা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা ডেমোক্র্যাট-সমর্থক।
অপরদিকে, ট্রাম্প ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিওকে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে তার এই বাছাই এবং নিয়োগে মার্কিন সরকার যেভাবে তার পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করে এবং আগামী চার বছরে বিশ্বে আমেরিকা যে ভূমিকা পালন করবে তাতে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিচার বিভাগকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করতে চান। ট্রাম্পের দাবি, প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রার্থিতা ব্যাহত করতে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফৌজদারি মামলা আনা হয়েছিল। যদিও বিচার বিভাগ বলছে, তারা রাজনৈতিক পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প অব্যর্থভাবে তার অনুগতদের বেছে নিয়েছেন, যারা ট্রাম্পের সবচেয়ে বিতর্কিত নির্দেশের বিরুদ্ধে যাবে এমন আশংকা নেই।
২০১৭ সালে ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সেই তুলনায় তার এবারের প্রশাসন আরও অস্থির ও বিপজ্জনক এক বিশ্বের মুখোমুখি হবে। তাদেরকে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধের এবং যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাশিয়া ও ইরানের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা চীনের মোকাবেলা করতে হবে। ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ তার রাজনৈতিক শত্রুদের ওপর চড়াও হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনি প্রচারের সময়। ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনারেল গেটজও এ থেকে পিছু হটবেন বলে মনে হয় না। গেটজের মনোনয়ন ঘোষণার পর ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, “ট্রাম্প যা বলবেন গেটজ ঠিক তাই করবেন।”
দাতা, পরামর্শক এবং তহবিল সংগ্রহকারীসহ ট্রাম্প জগতের ঘনিষ্ঠ অর্ধ ডজন সূত্র ব্যক্তিগতভাবে বলেছে, তারা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে গেটজকে বেছে নেওয়ার কারণে হতবাক হয়েছেন, কারণ এ পদে তার যোগ্যতা খুবই সামান্য এবং তার বিরুদ্ধে অতীতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ছিল।
মেইনের মধ্যপন্থী রিপাবলিকান সিনেটর সুসান কলিন্স গেটজকে ট্রাম্পের বেছে নেওয়া সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি হতবাক হয়েছি যে, তাকে মনোনীত করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “অবশ্যই প্রেসিডেন্ট যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনয়ন দেওয়ার অধিকার রাখেন। তবে আমি মনে করি এটি একটি উদাহরণ যে, কেন আমাদের সংবিধানে পরামর্শ এবং সম্মতির বিধান থাকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
আর্মড সার্ভিসেস কমিটিতে থাকা ইলিনয়ের এক ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর বলেন, “প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে ট্রাম্পের বেছে নেওয়া হেগসেথেরও তেমন অর্থবহ কোনও যোগ্যতা নেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। সেই পদে পিট হেগসেথের মতো বিপজ্জনকভাবে অযোগ্য একজনকে বসানো এমন একটি ব্যাপার যা আমাদের সবার কাছেই ভয়ের।”
ট্রাম্প প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে হেগসেথের মনোনয়ন ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরোধীদলের কিছু সদস্য তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তবে ট্রাম্প নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে হেগসেথের প্রশংসা করেছেন। হেগসেথ যুক্তরাষ্ট্রে আর্মি ন্যাশনাল গার্ডের সাবেক কর্মকর্তা। তার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, তিনি আফগানিস্তান, ইরাক এবং কিউবার গুয়ানতানামো বে-তে দায়িত্বপালন করেছেন।
অপরদিকে, ‘টিকাবিরোধী’ কেনেডি জুনিয়রকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভার দিচ্ছেন ট্রাম্প। নির্বাচনের আগে শেষ দুই মাসে তিনি ‘মেইক আমেরিকা হেলদি এগেইন' নামে ট্রাম্পের একটি প্রচার উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, কেনেডি জুনিয়র কোভিডের সময় টিকাবিরোধী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কেনেডি জুনিয়রের এই মনোনয়ন সিনেটে অনুমোদন পেলে তিনি খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে চিকিৎসা গবেষণা এবং কল্যাণ কর্মসূচির মতো দায়িত্ব পাবেন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল