আজকের যান্ত্রিক ও প্রযুক্তি নির্ভর জীবনে ‘মনোযোগ ধরে রাখা’ যেন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অগণিত নোটিফিকেশন, দ্রুতগতির জীবনধারা এবং নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল বার্তাপ্রবাহ আমাদের মনোযোগকে ক্ষণস্থায়ী, অস্থির ও বিভ্রান্তিকর করে তুলছে। আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানুষের গড় মনোযোগের সময়সীমা আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা আরো প্রকট।
এমন অবস্থায় একজন মানুষ কীভাবে নিজের মনকে স্থির, শান্ত ও একাগ্র রাখবে? প্রযুক্তির প্রলোভন থেকে নিজেকে সরিয়ে কীভাবে মনোযোগকে নিয়ন্ত্রণে আনবে? এর উত্তর নিহিত আছে নামাজে, যেটি একটি চিরন্তন ইবাদত। যা শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ নয়, বরং মানসিক প্রশান্তি ও মনঃসংযোগ বৃদ্ধির একটি কার্যকর মাধ্যম।
নামাজ হলো একাগ্রতা অনুশীলনের একটি অন্যতম মাধ্যম। নামাজ কেবলমাত্র শারীরিক কিছু অনুশীলন নয়, এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক ধ্যান, যেখানে প্রতিটি শব্দ, রুকু, সিজদা ও দোয়া মানুষের মনকে একাগ্র করে তোলে। এ জন্যই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নামাজে নিহিত রাখা হয়েছে আমার নয়নপ্রীতি।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩৯৪০)
মনোবিদদের মতে, এ ধরনের নিয়মিত একাগ্র অনুশীলন আমাদের মনোযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে নিয়মিত খুশু (একাগ্রতা) সহকারে নামাজ আদায়কারীদের মধ্যে মানসিক স্থিরতা এবং চিন্তার গভীরতা লক্ষ করা যায়।
নিম্নে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সালাতের কিছু উপকারিতা তুলে ধরা হলো—
নামাজের প্রত্যক্ষ কিছু উপকারিতা
মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি : যাঁরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন, তাঁরা বলেন, পড়াশোনা, কাজ বা দৈনন্দিন ব্যস্ততার মধ্যেও এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করেন, যা মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। নবীজি (সা.) মানসিক স্বস্তি লাভের জন্য নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিতেন।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, সালিম ইবনে আবুল জাদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, মিস‘আর বলেছেন, যদি আমি সালাত পড়তাম তাহলে প্রশান্তি পেতাম। উপস্থিত লোকজন নারাজ হলো। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হে বিলাল, নামাজ কায়েম করো। আমরা এর মাধ্যমে স্বস্তি লাভ করতে পারব।
(আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৮৫)
চাপ ও দুশ্চিন্তা হ্রাস : বিভিন্ন ইসলামিক ও সাইকোলজিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খুশু সহকারে নামাজ আদায় করে, তাদের মানসিক চাপ তুলনামূলক কম থাকে এবং তারা দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় অধিক সক্ষম হয়। এ জন্য দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও বিপদের দিনে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে বলেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৪৫)
ডিজিটাল ডিটক্স : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেন দিনের পাঁচটি বিরতি, যেখানে মানুষ প্রযুক্তি, ব্যস্ততা ও দুনিয়াবি চিন্তা থেকে সাময়িক মুক্তি পায়। এটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি পিয়ার-রিভিউড প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে— ‘ডিজিটাল ডিটক্স বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিরতির মতো উদ্যোগগুলো স্মার্টফোন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব, যেমন— উদ্বেগ, হতাশা, মানসিক চাপ, সামগ্রিক মানসিক সুস্থতা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা হ্রাস করতে পারে। (সূত্র : https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC11392003/)
শৃঙ্খলাবোধ ও রুটিন গঠন : সময়মতো নামাজ আদায় একজন মানুষকে শৃঙ্খলিত জীবনযাপনে সহায়তা করে। এই শৃঙ্খলাবোধ থেকেই জন্ম নেয় মনোযোগ।
এগুলো নামাজের কিছু পার্থিব উপকারিতা মাত্র। নামাজের মূল পরিচয় হলো, নামাজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, মুক্তির সনদ, আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম। তাই আমাদের সবার উচিত নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া।
লেখক : শিক্ষার্থী, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়