বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক প্রবাসী। তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম দেশগুলোতে বসবাস করলেও অমুসলিম দেশেও থাকেন অনেকে। অমুসলিম দেশে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদের আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে চাই বিশেষ সতর্কতা। কেননা ইসলাম হালাল জীবিকা অর্জনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এখানে এ বিষয়ে শরিয়তের নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।
উপার্জন হালাল হওয়ার গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ হালাল ও বৈধ উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা উত্তম খাবার ভক্ষণ করো এবং নেক আমল করো।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৫১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অন্যান্য ফরজের পর হালাল উপার্জন অনুসন্ধান করা একটি ফরজ।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৪৬০)।
উপার্জন হালাল হওয়ার মূলনীতি
মানুষের উপার্জন হালাল বা হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে শরিয়তের কয়েকটি মূলনীতি আছে। যেমন-
১. কাজটি বৈধ হওয়া : কোনো কাজের মাধ্যমে উপার্জন হালাল হওয়ার শর্ত হলো কাজটি বৈধ হওয়া। এই মূলনীতির আলোকে সব বৈধ বিক্রি, সেবা ও ভাড়া বৈধ হবে। যেমন- খাদ্য, ওষুধ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বিক্রি করা। মানুষকে শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ অন্যান্য বৈধ সেবা দেওয়া। বাড়ি, দোকান ও গাড়ি ভাড়া দেওয়া।
২. হারাম না হওয়া : কোনো হারাম কাজ বা হারাম কাজে সহায়ক কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা হারাম। যেমন- সুদ খাওয়া, সুদি ব্যাংকে চাকরি করা, মদ বহন করা, জুয়ার হল প্রস্তুত করা, প্রতারকের কাছে প্রতারণার মাধ্যম বিক্রি করা এবং ডাকাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা ইত্যাদি। উল্লিখিত কাজগুলো হয়তো নিজে হারাম নতুবা হারাম কাজের জন্য সহায়ক।
৩. দূরবর্তী সাহায্য হলে হারাম নয় : যদি ব্যক্তির পাপ কাজে সাহায্য করার ইচ্ছা না থাকে, কিন্তু এর মাধ্যমে হারাম কাজে দূরবর্তী সাহায্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তা হারাম নয়।যেমন- অবিশ্বাসী, সুদখোর বা জুয়াখোরের কাছে বৈধ খাবার ও ওষুধ বিক্রি করা বৈধ। এ ক্ষেত্রে এটা বলা যাবে না যে এই খাবার ও ওষুধ খেয়ে ব্যক্তি পাপ কাজের শক্তি পাচ্ছে, সুতরাং তা হারাম হবে। এ জন্য মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লেনদেন করতেন।
৪. হালাল-হারাম পৃথক হলে চাকরির অবকাশ : যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে হারাম কারবার হয় এবং হালাল কারবারও হয় এবং হালাল-হারামের হিসাব ভিন্ন হয়, তখন অপারগ ব্যক্তি হালাল অংশে চাকরি করতে পারবে। যেমন- কোনো বেকারিতে হালাল রুটি বিক্রি করার পাশাপাশি মদের সঙ্গে মিশ্রিত হারাম রুটিও বিক্রি করা হয়, কিন্তু কোনো কর্মচারীর কাজ কেবল হালাল রুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং সে যদি কোনোভাবে হারামে সহায়তা না করে; তাহলে সেই ব্যক্তি অপারগ হলে চাকরিটি করতে পারবে। তবে এমন ব্যক্তির উচিত অন্য চাকরি খুঁজতে থাকা। কেননা তার দায়িত্ব হলো মন্দ কাজে বাধা দেওয়া এবং তা সম্ভব না হলে স্থান ত্যাগ করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যখন আল্লাহর আয়াতগুলোকে অমান্য ও বিদ্রুপ করতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সঙ্গে (অমান্যকারী ও বিদ্রুপকারীদের সঙ্গে) বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। নতুবা তোমরাও তাদের মতোই হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফেরদের সকলকে জাহান্নামে একত্র করবেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪০)।
আল্লামা জাসসাস (রহ.) বলেন, ‘এই আয়াতে প্রমাণ রয়েছে যে মন্দ কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে বাধা দেওয়া আবশ্যক। বাধা দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে ঘৃণা প্রকাশ করা, মন্দ কাজে লিপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে ওঠাবসা পরিত্যাগ করা এবং মন্দ কাজ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত তাকে বর্জন করা; যদি মন্দ কাজকে একেবারে দূর করা না-ও যায়।’ (আহকামুল কোরআন : ২/৪০৭)।
৫. সংশয়যুক্ত উপার্জন পরিহারযোগ্য : কোনো উপার্জনের ক্ষেত্রে যদি হারাম হওয়ার সন্দেহ হয়, তাহলে তাকওয়ার দাবি হলো তা পরিহার করা। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্দিহান বিষয় হতে নিজেকে রক্ষা করেছে, সে নিজের দ্বিনকে পবিত্র করেছে এবং নিজের ইজ্জতকেও রক্ষা করেছে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে পতিত হয়েছে, সে হারামে পতিত হয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টতই বলেছেন, ‘সন্দেহযুক্ত বিষয় বর্জন করে সন্দেহমুক্ত বিষয় গ্রহণ করো।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস :৫৭১১)।
আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত
আল্লাহ মানুষের জন্য পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন। সুতরাং হালাল গ্রহণ এবং হারাম বর্জনে মানুষের কুণ্ঠা করা উচিত নয়। প্রয়োজন শুধু অনুসন্ধান করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরিশ্রম করা। যে ব্যক্তি হারাম থেকে বাঁচতে সচেষ্ট হবে, আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন।
আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য সংকটমুক্তির পথ করে দেবেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করবেন, যা সে ধারণাও করে না।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ২-৩)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দিন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ