যত দিন যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) আতঙ্ক ততই সাধারণ মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এই আতঙ্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ছয়। গত শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাজ্যটির জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে অন্নদা রায় (৩৮) ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে মন্টু সরকার (৫২) নামে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
পরদিন শনিবার উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে হৃদরোগে মৃত্যু হয় মন্টু মন্ডল (৩৬)-এর। ওইদিনই বসিরহাটের বাসিন্দা মোমিনা বেওয়া (৫৫) নামে এক নারীরও মৃত্যু হয়। গত রবিবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বসিরহাটেই মৃত্যু হয় ইট ভাঁটার শ্রমিক কামাল হোসেন মন্ডলের (৩২)। ওই জেলারই শাসন এলাকায় মৃত্যু হয়েছে আয়েপ আলি (৫২) নামে আরও এক ব্যক্তির।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই মৃত্যুর নেপথ্যে কারণ একটাই- নাগরিক পঞ্জি আতঙ্ক। মৃতের পরিবারের সদস্যরাও অভিযোগ করেছেন তাদের পরিবারের মৃত সদস্যরা হয় রেশন কার্ড সংশোধন করতে গিয়ে নয়তো দলিল সম্পর্কিত সমস্যায় আতঙ্কগ্রস্থ ছিলেন।
গত ৩১ আগষ্ট আসামে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পায়। তালিকায় অন্তর্ভুক্তি হয়েছে ৩ কোটির কিছু বেশি নাম। কিন্তু সেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখের বেশি নাম। বিদেশি ট্রাইব্যুনালে তাদের পুনরায় আবেদন জানানোর সুযোগ থাকলেও বহু মানুষ দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্কে দিন গুনছেন। ভবিষ্যত ঘিরে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এমন এক পরিস্থিতিতে আসামের মতো এ রাজ্যেও এনআরসি চালু করতে চায় বিজেপি। যদিও এনআরসি চালু করার ব্যাপারে সরকারিভাবে এখনও কিছুই ঘোষণা করা হয়নি। তবু আসামের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাংলাতেও।
নাগরিক পঞ্জির প্রতিবাদে কয়েকদিন আগেই রাজপথে নেমেছেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। জেলায় জেলায়ও প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ-বিধায়ক-কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। কোথাও আবার প্রতিবাদের নামে সড়ক, রেল অবরোধ হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’এর কুশপুতুলও পোড়ানো হয়েছে।
যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এ রাজ্যে এনআরসি করতে দেওয়া হবে না বলে বারবার ঘোষণা করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্বেও রাজ্যের মানুষ যেন তাতে ভরসা করতে পারছেন না। বিশেষ করে কয়েকদিন আগে দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’এর সাথে বৈঠকের পর মমতার সম্পর্কে যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তাতে আরো ইন্ধন যুগিয়েছে রাতারাতি রেশন কার্ডের সাথে আধার কার্ডের নাম্বার লিংক করানোর সরকারি বিজ্ঞপ্তি। সেখানে বলা হচ্ছে রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি সবকিছুতেই যদি কোন ভুল থাকে তবে তা যেন শিগগিরি সংশোধন করিয়ে নেওয়া হয়। ফলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হচ্ছে। ফলস্বরূপ বিডিও, গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস, পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলিতে মানুষের লম্বা লাইন চোখে পড়ছে।
সোমবারও কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শ্রমিক সংগঠনের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এনআরসি প্রসঙ্গ টেনে আনেন মমতা। তিনি বলেন ‘আসামে দেখছেন এনআরসি-তে কত লোক মারা গেছে। খুবই দু:খের যে বাংলাতেও এনআরসির ভয়ে ছয় জন মারা গেছে। কিন্তু বাংলায় কেন, এনআরসি কোথাও হতে দেবো না। আসাম চুক্তি অনুযায়ী সেখানে এনআরসি হয়েছে। এখানে কে করবে? রাজ্য সরকারের মেশিনারিই তো চাই, কিন্তু আমরা তো কোনদিন করতে দেব না।’
এনআরসি নিয়ে বিজেপি যেভাবে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকেও নিশানা করে তিনি বলেন ‘বিজেপি তাদের রাজনৈতিক প্রচারের জন্য এই কাজ করছে কিন্তু গণমাধ্যমের একটা অংশ তাদের টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) বাড়ানোর জন্য খুব অপপ্রচার করছে। এই লজ্জা ঢাকার কোন জায়গা নেই।’
রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন চিন্তা করছেন? আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আপনারা এরাজ্যে বাস করেন। এ রাজ্যের নাগরিক। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে কে কি প্রচার করলো, দয়া করে তার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মূল্যবান জীবন নষ্ট করবেন না। ওদের (বিজেপি)-কে বলুন আগে ত্রিপুরায় এনআরসি করতে, দেখবেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর নামই বাদ যাবে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলে দিয়েছেন ওখানে তারা এনআরসি মানবেন না। আমরা আপনাদের সাথে ছিলাম, আছি, থাকবো। আমরা আধখানা রুটি খেলে আপনাদেরও আধখানা রুটি দেবো।’ যাদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র হারিয়ে গেছে তারা যেন বুদ্ধি করে স্থানীয় পুলিশ থানায় গিয়ে একটা এফআইআর করে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
তবে বিজেপি অবশ্য নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে পুরনো অবস্থানে থেকেই অনড় থেকেছে। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে লোককে ভয় দেখাচ্ছে। আমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনছি। এই বিল নিয়ে মানুষের সাথে আলোচনা করবো। এর আওতায় আমরা সমস্ত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেবো, এরা কেউ দেয়নি। মমতা ব্যানার্জি নোট বন্দি, জিএসটি, তিন তালাক বিল, ৩৭০ ধারা বিলোপ কোনো কিছুই আটকাতে পারেননি। এনআরসি যদি আমরা করি, তবে মমতা ব্যানার্জি সেটাও আটকাতে পারবেন না।’
বিডি প্রতিদিন/হিমেল