কিবলা নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বিশেষ করে নামাজের জন্য তা অপরিহার্য বিষয়। যারা সচক্ষে কাবাগৃহ দেখতে পায়, যেমন- মক্কাবাসীরা, তাদের কিবলা হলো সরাসরি কাবাগৃহ। আর যারা সরাসরি কাবাগৃহ দেখতে পায় না তাদের কিবলা হলো কাবার দিক।
নামাজে কিবলার বিধান হলো, কেউ যদি কাবাঘরের অবস্থান থেকে ডানে-বাঁয়ে ৪৫ ডিগ্রি করে সর্বমোট ৯০ ডিগ্রি অঞ্চলের ভেতরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে, তাহলেই নামাজ হয়ে যাবে। তাই কোনো মসজিদের মিহরাব কিবলার মূল দিক থেকে সামান্য এদিক-সেদিক হয়ে গেলেও বিচলিত হওয়ার কারণ নেই, কেননা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে প্রায়ই দেখা যায় যে সেগুলোর কিবলা উপরোল্লিখিত ৯০ ডিগ্রির ভেতরই পড়ে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝখানের অঞ্চলটি হলো কিবলার দিক।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটি মদিনা শরিফের হিসাবে বলেছিলেন। সে হিসাবে বাংলাদেশ থেকে মক্কা যেহেতু পশ্চিম দিকে, তাই আমাদের কিবলা হবে উত্তর ও দক্ষিণের মাঝে তথা পশ্চিম দিকে কাবা শরিফের ডানে-বাঁয়ে ৪৫ ডিগ্রি অঞ্চল।
দিক নির্ণয়ের মাধ্যম ও পদ্ধতি
আল্লাহ তাআলা দিক নির্ণয়ে সহজতার জন্য প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপায় রেখে দিয়েছেন। মানুষ সেসব উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করে কিবলা নির্ধারণ করতে পারে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর নিদর্শনাবলি ও তারকারাজির মাধ্যমে তারা পথ নির্ণয় করে থাকে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১৬।
আয়াতটির ব্যাখ্যায় তাবেঈ কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন তিনটি উদ্দেশ্যে- আসমানের সৌন্দর্যের জন্য, শয়তানকে বিতাড়নের জন্য এবং দিক নির্ণয়ের জন্য।’ (সহিহ বুখারি : ৪/১০৭)।
সূর্যের মাধ্যমে দিক নির্ণয়
সূর্যের মাধ্যমে যেকোনো দেশে এবং যেকোনো স্থানে দিক নির্ণয় করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে সূর্যের গতিচক্র তথা উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণের মৌসুমকে মিলিয়ে নির্ধারণ করতে হবে। সূর্যের মাধ্যমে সহজে কিবলা নির্ণয়ের পদ্ধতি হলো- ২৮ মে বিকাল ৩:১৮ অথবা ১৬ জুলাই ৩:২৬-এর সময় সূর্যটি ঠিক কাবাঘর বরাবর থাকে। তখন তা দেখে আমাদের মসজিদের কিবলা ও মিহরাবের দিক ঠিক করতে অনেক সহজ হবে। উল্লেখ্য যে কাবা শরিফ ২১.৪২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে এবং ৩৯.৮২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।
ধ্রুবতারার মাধ্যমে
রাতের বেলা ধ্রুবতারার মাধ্যমে দিক নির্ণয় সম্ভব। ধ্রুবতারা বাংলাদেশের উত্তর দিগন্ত থেকে ২৩ ডিগ্রি ওপরে উত্তর আকাশে থাকে। আর যত উত্তর মেরুর দিকে যাওয়া হবে, তত ওপরের দিকে দেখা যাবে। তাই বিষুবরেখার বেশি দক্ষিণ দিকে চলে গেলে আর দেখা যাবে না। এ জন্য ধ্রুবতারা দক্ষিণ অক্ষাংশের লোকেরা দেখতে পায় না।
ধ্রুবতারা চেনার পদ্ধতি হলো, আকাশে সাতটি তারকার সমন্বয়ে দুটি তারকাপুঞ্জ আছে, যেগুলোকে ‘সপ্তর্ষিমণ্ডল’ বলা হয়। একটি হলো বৃহৎ সপ্তর্ষিমণ্ডল, এই বৃহৎ সপ্তর্ষিমণ্ডলের সবার ওপরের তারকাটি থেকে ওপরের দিকে রেখা টানলে যে তারকার সঙ্গে গিয়ে লাগে, সেটিই হচ্ছে ধ্রুবতারা। দ্বিতীয়টি হলো লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডল, এই লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডলের সবার ওপরের তারকাটিই হচ্ছে ধ্রুবতারা।
ত্রিশঙ্কু তারকার মাধ্যমে
এটিও একটি নক্ষত্রপুঞ্জ, যার সামষ্টিক আকৃতি ক্রুশ চিহ্নের মতো মনে হয়, তাই তাকে এই নাম দেওয়া হয়েছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, ধ্রুবতারা দক্ষিণ অক্ষাংশের লোকেরা দেখতে পায় না। তাই আল্লাহ তাআলা দক্ষিণ অক্ষাংশের লোকদের দিকনির্দেশের জন্য ‘ত্রিশঙ্কু নক্ষত্রপুঞ্জ দিয়েছেন।
কালপুরুষ নক্ষত্রের মাধ্যমে
এটিও একটি নক্ষত্রপুঞ্জ, যার সমষ্টিকে একজন বীরপুরুষের আকৃতিতে কল্পনা করা হয়। ইংরেজিতে তাকে ড়ত্রড়হ বলা হয়। এটাকে গ্রামাঞ্চলের অনেকে ‘আদমসুরত’ বলে। এ নক্ষত্রপুঞ্জটি সন্ধ্যায় পূর্বাকাশে, মধ্যরাতে মধ্যাকাশে ও শেষ রাতে পশ্চিম আকাশে চলে যায়।
কম্পাস বা দিক নির্ণয়ক যন্ত্রের মাধ্যমে
কম্পাসের মাধ্যমে উত্তর দিক নির্ণয় হয়, আর যেকোনো দিক নির্ধারণ করা গেলে বাকি দিকগুলোও সহজে বের হয়ে যায়। উত্তরকে ০ ডিগ্রি ধরে, এরপর ডানে ৯০ ডিগ্রিতে পূর্ব, ১৮০ ডিগ্রিতে দক্ষিণ এবং ২৭০ ডিগ্রিতে পশ্চিম। এরপর ৩৬০ ডিগ্রিতে গিয়ে আবার উত্তরে পৌঁছবে।
মোবাইলে কিবলা ডিরেকশন অ্যাপ
মোবাইলেও Qibla direction অ্যাপগুলোর মাধ্যমে কিবলার দিক বের করা যায়। হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সঠিক দিক নির্ণয়ের জন্য তাতে ‘ম্যাগনেটোমিটার সেন্সর’ থাকা আবশ্যক। অনেক মোবাইলে তা থাকে না, এটি না থাকলে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে না।
তবে কম্পাস বা মোবাইল দ্বারা দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্মর্তব্য হলো, উত্তর দিক দুই ধরনের : ১. ভৌগোলিক উত্তর, ২. চুম্বকীয় উত্তর। মানচিত্রে যে উত্তর দেখানো হয় এবং আমরা সাধারণত যে দিকটাকে উত্তর বলি তা হচ্ছে ‘ভৌগোলিক উত্তর’। আর কম্পাসে যে উত্তর দেখানো হয় তা ‘চুম্বকীয় উত্তর’। তা ভৌগোলিক উত্তর থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে অবস্থিত। কেননা পৃথিবীর চুম্বকীয় অঞ্চল সেদিকে অবস্থিত। হ্যাঁ, নন-ম্যাগনেটিক ‘জাইরো কম্পাস’ এবং কিছু মোবাইল অ্যাপ চেঝ ও নেটওয়ার্ক ডেটা ব্যবহার করে মূল ভৌগোলিক উত্তর হিসাব করে সঠিক কিবলা প্রদর্শন করতে পারে।
মহাকাশ স্টেশন বা ভিন্ন গ্রহ থেকে কিবলা নির্ণয়
মানুষ স্বশরীরে চাঁদে পৌঁছে গেছে এবং অন্যান্য গ্রহেও পৌঁছার প্রচেষ্টা চলছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, যা মহাকাশ গবেষণার জন্য মহাশূন্যে স্থাপিত হয়েছে, তা পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় ভাসছে। এটি প্রতি ৯০ মিনিটে একবার কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে। এতে সেখানে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১৬ বার সূর্য উদয় ও অস্ত হতে দেখা যায় তথা দিন-রাত ঘটে। ইদানীং অনেক মুসলিমও মহাশূন্যে সফর করছেন। প্রশ্ন হলো, মহাকাশে নামাজ কোন দিকে ফিরে পড়বে?
এ ক্ষেত্রে কথা হলো, কাবা শরিফের কেবল চতুর্দেয়ালই কিবলা নয়; বরং এর বরাবর মাটি থেকে আরশ পর্যন্ত অসীম সরলরেখাটি কিবলা হিসেবে গণ্য। তাই যদি চাঁদের দিগন্তে পৃথিবী দেখা যায়, তবে পৃথিবীই তার কিবলার দিক। তখন পৃথিবীর দিকে মুখ করাই যথেষ্ট। তদ্রূপ মহাকাশ স্টেশন থেকেও পৃথিবীর সেই গোলার্ধের দিকে মুখ করবে, যেখানে কাবা শরিফ অবস্থিত। (ফলকিয়াতে জাদিদা, পৃষ্ঠা-২০৭)। হ্যাঁ, মহাকাশচারীরা পৃথিবী থেকে বেশি দূরে চলে যাওয়ায় কিবলা নির্ণয়ে অক্ষম হলে যেকোনো দিকে ফিরে নামাজ পড়লেও আদায় হয়ে যাবে।
আল্লাহ তাআলার বাণী- ‘আল্লাহর জন্যই পূর্ব-পশ্চিম সব দিক, তোমরা যেদিকে মুখ ফিরাও, সেদিকেই আল্লাহ আছেন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১১৫)।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ