বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘জঙ্গি আস্তানা’ রংপুরের টাঙ্গাইলপাড়া

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের একটি অজপাড়াগাঁয়ের নাম টাঙ্গাইলপাড়া। এখানকার মানুষ অত্যন্ত সহজ-সরল। সেই টাঙ্গাইলপাড়া এখন ‘জঙ্গি আস্তানা’ হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। গত এক বছরে যে কজন ‘জঙ্গি’ রংপুর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, তারা সবাই টাঙ্গাইলপাড়ার বাসিন্দা। এদের মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রশিক্ষক, আঞ্চলিক কমান্ডার, ইউনিট কমান্ডার, অস্ত্র স্কোয়াডের কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডার। ২৭ জুলাই ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত ৯ জঙ্গির একজন রায়হান কবীর ওরফে তারেকের বাড়িও টাঙ্গাইলপাড়ায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ‘জঙ্গি আস্তানা’ হিসেবে চিহ্নিত করে টাঙ্গাইলপাড়াকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইলপাড়াকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত করে এলাকাটি কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত যতজন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সবাই টাঙ্গাইলপাড়ার বাসিন্দা। তবে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর অন্যরা গা ঢাকা দিয়েছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের নেটওয়ার্ক।

পশুয়া থেকে টাঙ্গাইলপাড়া : টাঙ্গাইলপাড়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুর রউফ জানান, টাঙ্গাইলপাড়ার আদি নাম পশুয়া। পাকিস্তান আমলে টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকটি পরিবার এখানে এসে বসবাস শুরু করে। পরে গ্রামটির নামকরণ করা হয় টাঙ্গাইলপাড়া।

জেএমবির উত্থান : এলাকাবাসী ও পুলিশের ভাষ্যমতে, ২০০০ সালে টাঙ্গাইলপাড়ায় কুয়েতভিত্তিক সংস্থা ইসলামিক হেরিটেজ একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেয়। জেএমবির শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। এলাকাবাসী তাকে দিয়ে মসজিদটি উদ্বোধন করান। বাংলাভাইয়ের নির্দেশে তার শিষ্য মাওলানা বেলাল হোসেনকে এ মসজিদের ইমামের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে জেএমবিতে যোগ দিয়ে বেলাল হোসেনই রংপুরের পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলাসহ রংপুর অঞ্চলে জেএমবির কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি ছিলেন জঙ্গিদের দীক্ষাগুরু। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জেএমবি নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান ও সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ওরফে সোহেলকে এ মসজিদেই কিছু দিন আশ্রয় দিয়েছিলেন বেলাল হোসেন। গত বছর ১৭ জুলাই বেলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিছু দিন পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও জঙ্গি তত্পরতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফের শনিবার গভীর রাতে রংপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর এলাকায় তিন সঙ্গীসহ বেলাল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে রিভলবার, গুলি ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে গ্রেফতার করা হয় জেএমবির রংপুর আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (২১), অস্ত্র স্কোয়াডের কমান্ডার ইছাহাক আলী (২৫), হসার সদস্য লিটন মিয়া ওরফে রফিক (২৩) ও আবু সাইদকে (২৮)। ইছাহাক ইরাক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে জেএমবিতে যোগ দেন। এরা সবাই জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও, মাজারের খাদেম রহমত আলী, পঞ্চগড়ের মঠ অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায় হত্যা এবং বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এরা বর্তমানে কারাগারে আছেন। কোনিও হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আরেক আসামি জেএমবি সদস্য চান্দু মিয়ার বাড়িও টাঙ্গাইলপাড়ায়। তিনি পলাতক। একই এলাকার বাসিন্দা রংপুর ইউনিট কমান্ডার খয়বর হোসেন গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে পলাতক রয়েছেন। বেলাল হোসেন এদের সবার প্রশিক্ষক ছিলেন বলে রবিবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। ২৭ জুলাই ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত ৯ জঙ্গির একজন রায়হান কবির ওরফে তারেকের বাড়িও টাঙ্গাইলপাড়ায়। রায়হান কবির জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন। গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর চরে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। রায়হান কবির টাঙ্গাইলপাড়ার সেই আলোচিত মসজিদে কয়েক মাস মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন। ২৮ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য  দিয়েছিলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। টাঙ্গাইলপাড়ার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক আশরাফ আলী বলেন, ‘এলাকায় জঙ্গি আস্তানা গড়ে উঠবে ভাবতেই পারিনি। বেলাল হোসেনের নেতৃত্বেই কতিপয় ব্যক্তি জঙ্গিবাদের মতো জঘন্য কাজে জড়িত হওয়ায় টাঙ্গাইলপাড়ার মর্যাদা ধুলায় মিশে গেছে। নিজেদের টাঙ্গাইলপাড়ার বাসিন্দা বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসে।’

সর্বশেষ খবর