সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নৌ দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন কবে

বিদেশে জাহাজে চাকরির নামে মানব পাচার!

আহমদ সেলিম রেজা

অবৈধ এনওসি প্রদান, নৌযানের ভুয়া ফিটনেস সনদ, জাল মাস্টারশিপ সনদ, মাস্টার-ড্রাইশিপ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিধিবহির্ভূতভাবে নৌযানের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত আটকে যাচ্ছে বার বার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তারই নির্দেশে গত ১৬ অক্টোবর নৌ অধিদফতরের দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) নেতৃত্বে এক সদস্যের এ কমিশন গঠন করে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিদেশে জাহাজে চাকরির নামে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ দিয়ে একটি গোষ্ঠী মানব পাচারে সক্রিয়— পুলিশের এমন অভিযোগ নিয়েও নীরব নৌ মন্ত্রণালয়। পুলিশের বিশেষ শাখার (ইমিগ্রেশন) অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পাঁচ মাসেও। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সংসদীয় কমিটিতেও। কিন্তু সুরাহা হয়নি। তবে কোন অদৃশ্য সুতার টানে আটকে যাচ্ছে সব কিছু— তাও জানা যায়নি। এসব তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে কবে সে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিলকৃত অভিযোগের সূত্র ধরে মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও নৌ অধিদফতরের বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় চাঞ্চল্যকর আরও সব তথ্য। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের দাবি, এনওসি দেওয়ার চেয়ারটি লোভনীয়। এ চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় এ অভিযোগ উঠছে। এই পদে যিনি দায়িত্বে আছেন, তিনি একই সঙ্গে পালন করেন আটটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নৌ অধিদফতরে চলমান গ্লোবাল মেরিন ডিস্ট্রেস্ড অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) প্রকল্পের পরিচালক পদ সামলানোর পাশাপাশি তাকে অভ্যন্তরীণ জাহাজের ড্রাইভারশিপ সনদ, সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক পরীক্ষা ও এনওসি প্রদান, সব ধরনের অভ্যন্তরীণ নৌযান সার্ভেসহ রেজিস্ট্রেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। মূল পদের নাম ‘ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার’। অনেকে এই চেয়ারে আসতে চান বলে এত বিতর্ক। পুলিশের বিশেষ শাখা (ইমিগ্রেশন) সূত্রে জানা যায় ঠিক এর বিপরীত চিত্র। সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও নৌ মন্ত্রণালয়ের যৌথসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিদেশে জাহাজে চাকরির নামে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ প্রদান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত না মেনে নৌ অধিদফতরের অব্যাহতভাবে এনওসি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত জুনে বিষয়টি হাতেনাতে ধরা পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। নৌ অধিদফতরের এনওসিসহ পুলিশের বিশেষ শাখার (ইমিগ্রেশন) হাতে ধরা পড়ার পর তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। মাত্র ২০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার সময় বেঁধে দিয়ে গত ১৪ জুন গঠিত কমিটি এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। তবে জাল এনওসি প্রদানের দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে দুই-তিনবার। এরপর এনওসি প্রদানকারী কর্মকর্তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাক্ষরটি আসল কি-না তা যাচাই-বাছাই করতে পাঠানো হয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের কাছে। এরপর সব ঝুলে যায়। নৌ অধিদফতরের এসব নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা  নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক নিরূপম দেবনাথ স্বাক্ষরিত পত্রে এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বলা হয়। গত ১৬ অক্টোবর অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে এক সদস্যের এ তদন্ত কমিশন গঠন করে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে নৌ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছেও দাখিল হয়েছে এমন অভিযোগ। কিন্তু কোনো তদন্ত কমিটি নৌ অধিদফতর থেকে কতটি এনওসি ইস্যু করা হয়েছিল, সর্বশেষ কবে ইস্যু করা হয়েছে- এ তথ্যই উদ্ধার করতে পারেনি। এনওসি ইস্যু করা হলেও তার রেকর্ডপত্র সংরক্ষিত হয় না। জানা যায়, অবৈধ এনওসি প্রদান ছাড়াও নৌ অধিদফতরের একটি জালিয়াত চক্র দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ফিটবিহীন নৌযানসহ অদক্ষ চালক সনদ পাচ্ছে নগদের বিনিময়ে। সূত্রমতে, চলমান গ্লোবাল মেরিন ডিস্ট্রেস্ড অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) প্রকল্পের জনৈক অস্থায়ী কর্মচারী ও নৌ অধিদফতরে কর্মরত স্থায়ী কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই চক্র। প্রকল্প পরিচালক যেহেতু একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার সেহেতু নৌ অধিদফতরের ‘চার্টার অব ডিউটিজ’ লঙ্ঘন করে ড্রাইভারশিপ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্বও তার। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ জাহাজের ড্রাইভারশিপ ও সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক পরীক্ষা এবং এনওসিসহ সব ধরনের অভ্যন্তরীণ নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন প্রদানের দায়িত্বও একই ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত। তাই এই চক্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির তালিকা দীর্ঘ। অবৈধ এনওসি, অভ্যন্তরীণ নৌযানের ভুয়া ফিটনেস সনদ প্রদান, জাল ড্রাইভারশিপ ও মাস্টারশিপ সনদ প্রদান, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মাস্টার-ড্রাইশিপ পরীক্ষায় পাসের ব্যবস্থা করা, বিধিবহির্ভূতভাবে শত শত নৌযানের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন দেওয়া, জাহাজের বে-ক্রসিংয়ের অনুমোদনসহ অবৈধ অর্থ নিয়ে অধিদফতরের চার্টার বিরোধী সব ধরনের কাজের সঙ্গে এ চক্র জড়িত। নারায়ণগঞ্জ নৌ অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, এ চক্রের এক সদস্য প্রকল্পে নিয়োগ পেলেও গত প্রায় চার বছর ধরে নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশনসহ অধিদফতরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এখন তাকে ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০টি নৌযান সার্ভে ও ১০টি নতুন নৌযান রেজিস্ট্রেশন হয়। কিন্তু সেই অফিসের সার্ভেয়ার মাসে একদিন অফিস করেন। তার পক্ষে সার্ভেয়ারের অফিস ব্যবহার করেন প্রকল্প পরিচালকের কর্মচারী। প্রকাশ্যে বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সেখানে যেসব নৌযান রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে হয়, সেগুলোর জন্য সরকারি ফির বাইরে নির্ধারিত হারে সার্ভিস চার্জ বা উপরি দিয়ে আসতে হয় ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীর কাছে। এ চক্রের হুকুম ছাড়া নারায়ণগঞ্জ অফিসের স্থায়ী কর্মচারী হয়েও কেরানিদের কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর