গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু ফার্মের জমি থেকে ৬ নভেম্বর সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় পুলিশের ছররা গুলিতে আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডু বাম চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার দ্বিজেন টুডুর বাড়ি গোবিন্দগঞ্জের মাদারপুরে গিয়ে দেখা গেল তিনটি শিশুসহ বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব নিয়ে সংসার চালাতে চোখে অন্ধকার দেখছেন দ্বিজেনের স্ত্রী উলিবিয়া হেমব্রম। জয়পুর গ্রামে দ্বিজেনের সত্তরোর্ধ্ব বাবা ইলিয়াম টুডুরও দৃষ্টিশক্তি কম। সকাল থেকেই মাটির ঘরের পাশে রাস্তার ধারে বসে থাকেন তিনি। কথা বলতেই উচ্চৈঃস্বরে বাড়িতে থাকা স্ত্রী চাম্পা মরমুকে ডাকলেন। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখা হয় দ্বিজেনের স্ত্রী আর তিন শিশু ইলিয় টুডু (১০), মারফিলি টুডু (৭) ও জিসায়েল টুডুর (৩) সঙ্গে। এক মাস ৪ দিন ধরে তারা খাওয়া-পরা নিয়ে খুবই কষ্টে আছেন বলে জানান উলিবিয়া। সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী দ্বিজেন খেতমজুরি করে সংসার চালাতেন। হাতে সঞ্চয় বলে কিছু ছিল না। এরপরও ধারকর্জ করে দ্বিজেনকে রংপুর ও ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নিতে হয়েছে। মানুষের সহায়তায় দ্বিজেনের চিকিৎসা চলছে। আর মাঝে-মধ্যে গ্রামে যা চাল-ডাল সাহায্য আসে তা থেকে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন চলছে বলে জানান তিনি। দ্বিজেনের বাবা ইলিয়াম টুডু বলেন, তার দাদা সিধু টুডুর ২৮ একর জমি ছিল বাগদা ফার্মে। তার ১ ছেলে এবং ২ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলে দ্বিজেনের সঙ্গেই থাকেন তিনি। এবার ফার্মের কিছু জমির দখল নিয়ে সেখানে টিনের ঘর তুলেছিলেন। একটি চা পানের দোকানও ছিল। ১ একর জমিতে কালাই এবং দেড় বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছিলেন। তাদের দুটি গরু ও তিনটি ভেড়াও ছিল। কিন্তু উচ্ছেদের দিন সেসব লুটপাট হয়ে গেছে বলে জানান দ্বিজেনের স্ত্রী। এখন তাদের কী হবে বলে কেঁদে দেন। এক চোখে কিছুটা দেখতে পারছেন দ্বিজেন কিন্তু শরীরে ছররা গুলি রয়ে গেছে অনেক। এ অবস্থায় আর কাজে ফিরতে পারবেন কিনা দ্বিজেন সে শঙ্কায় আছেন তারা। সংসারের ৬-৭ জন মানুষের খাওয়া-পরার জোগান কীভাবে হবে একদিকে সে চিন্তা।
অন্যদিকে স্বামীর অসুস্থতার চিকিৎসা শেষ পর্যন্ত কী হবে তা ভেবে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কথাগুলো বলার সময় পরিবারের সবার চোখে পানি নেমে আসে। শিশু তিনটিও শিশুসুলভ চঞ্চলতা ছেড়ে গম্ভীর হয়ে পড়ে।
সাঁওতালদের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগের এমপি ও চেয়ারম্যান জড়িত : একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তদন্তে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নির্মূল কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত ও মৌলবাদী গোষ্ঠী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে আওয়ামী লীগ নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা গোবিন্দগঞ্জে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও ১৮ সদস্যের জেলা কমিটি পাঠিয়েছিলাম। সেখানে গণশুনানি করেছেন। তিনি বলেন, নাসিরনগরে মাদ্রাসা থেকে মৌলবাদী ও হেফাজতরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। ব্যবহার করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে। রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত রোহিঙ্গাদের তালিকা করে জিহাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। ২০০৬ সালে এ রকম ১৭টি জিহাদি সংগঠনের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নসহ জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং আলাদা সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিতে আইনমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের ঘটনার নেপথ্যে কারণ উদ্বেগজনক। গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় স্পষ্টত স্থানীয় সংসদ সদস্য (আবুল কালাম আজাদ) ও চেয়ারম্যান (বুলবুল) জড়িত। ওই হামলা অমানবিক। এ জন্য কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? এই অমানবিক দৃশ্য দেখতে? নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপদেষ্টা বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সদস্য আরমা দত্ত, কলামিস্ট মাহবুবুর রশিদ ও লেখক আলী আকবর উপস্থিত ছিলেন।