শিরোনাম
সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরের কোন্দলে পড়ছে লাশ

হঠাৎ হানাহানি সংঘাত আওয়ামী লীগে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘরের কোন্দলে পড়ছে লাশ

বিরোধী দল বিহীন রাজপথে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ। দলটির অভ্যন্তরীণ দলাদলিতে সারা দেশেই খুনোখুনি বেড়েছে। দেশের বিভিন্নস্থানে প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক নেতা-কর্মীর লাশ পড়ছে।

সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পেশাগত দায়িত্বপালনকালে সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল নিহত হয়েছেন। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, পদ-পদবি, আধিপত্য ধরে রাখা, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত দুই মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত ২৫ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থক নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি-জামায়াতের এক শ্রেণির সুবিধাবাদী নেতা-কর্মী দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা দল ভারী করতে তাদের টেনে নিয়েছেন। এই সুবিধাবাদী শ্রেণি আওয়ামী লীগে যোগদান করায় দলীয় হানাহানি ও বিভেদ মাত্রা ছাড়িয়েছে। দলের এক শ্রেণির সংসদ সদস্যের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আওয়ামী লীগের কোন্দল বেড়েই চলেছে। দেশের বেশিরভাগ স্থানেই এ অবস্থা চলছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এটাও মনে করেন, বিরোধী দল সক্রিয় না থাকায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী কৌশলে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ায় খুনোখুনি ও কোন্দল বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও নেতা-কর্মীরা পরস্পর বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে সাধারণ মানুষও হতাহত হচ্ছেন। সর্বশেষ সিরাজগঞ্জের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল নিহত হয়েছেন।

তাদের মতে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়েছে। দলটির কোনো কোনো নেতার সময় ব্যয় হয় ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে। ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। দলের নীতি-নির্ধারকরা এসব ঘটনায় নেতা-কর্মীদের কড়া ভাষায় সতর্ক করলেও থামছে না মারামারি। দলটির নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, এখনই এগুলো না থামানো গেলে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড দলে চলতেই থাকবে। এতে বিরোধী বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যেতে পারে। তাই দলীয় শীর্ষপর্যায়কে কেবল মুখে নয়, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে দোষীদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন অপকর্ম বরদাস্ত করা হবে না। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় যে-ই জড়িত থাকুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল ভারী করার চেষ্টা চলছে। এই অনুপ্রবেশকারী পরগাছাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে অনেকে। বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলের কোন্দল-উপকোন্দল থাকতেই পারে। তবে সেটা খুনোখুনির ঘটনা ঘটবে তা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা ঠিক হবে না। এজন্য দলীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারি দল করার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে পার পেয়ে যাবে তা যেন না হয়। অপরাধীর পরিচয় অপরাধীই। তার শাস্তি নিশ্চিত করে অন্যদের শিক্ষা দিতে হবে, অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। কী কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলা পরিষদ, পৌর ও ইউনিয়ন নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আবার সামনে উপজেলা ভোট চলে এসেছে। এ জন্য নিজেদের মধ্যে কোন্দল বাড়ছে। তবে এসব কোন্দল এখন থেকেই শক্তহাতে দমন করতে হবে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পৌর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ভিপি রহিমের সমর্থকরা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর বাড়ি ঘেরাও করে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে গোলাগুলি শুরু হয়। সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে যাওয়া দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হন। সিরাজগঞ্জ পুলিশের ভাষ্য, পৌর মেয়রের গুলিতে সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল নিহত হয়েছেন। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতি মাসেই সেখানে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসে সেখানে তিনজন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার সকালে সদর উপজেলার মঠপাড়া গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইদ্রিস আলী (৪৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জিয়ারখী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আফজাল হোসেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জের ধরে জমি ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আবদুল কাদের সমর্থক শাহজাহান ইসলাম ও আফজাল হোসেন সমর্থক ইসমাইলের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। গত ১১ জানুয়ারি জেলার আওয়ামী লীগ নেতা ও পল্লী চিকিৎসক লুত্ফর রহমান সাবুকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ২২ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীর ওপর বেপরোয়া গুলি চালিয়েছেন ছালামত নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ২০ গ্রামবাসী আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও গত তিন মাসে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কমপক্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন। গত দুই মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও প্রতিপক্ষের হাতে আরও অন্তত ২৫ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থক নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার রাতে খুলনার ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ফুলতলা ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি জনি মোল্লা (৩৫) নিহত হয়েছেন। এর আগে বুধবার রাতে খুন হন নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রভাষ রায়। তার স্ত্রী টুটুল রানীর অভিযোগ, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের জের ধরে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ওই নির্বাচনের পরদিন প্রভাষ রায়ের বাড়িতে হামলা করেছিল স্বদলীয় প্রতিপক্ষ। বৃহস্পতিবার রাতে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান মডেল কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম হাসান খানকে (৫২) কুপিয়ে আহত করে নিজ দলের প্রতিপক্ষরা। এর আগে ১৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহালের দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত ও ২২ জন আহত হন। একই দিন (১৭ জানুয়ারি) সাতক্ষীরার চিংড়ি ঘের থেকে ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান ইমনের লাশ উদ্ধার করা হয়। গত বুধবার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাইউম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষ। চলতি বছরের প্রথম দিনই সংবাদের শিরোনাম হয় খুলনা আওয়ামী লীগ। আগের দিন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে গুলি করে তার প্রতিপক্ষ। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিহত হন পথচারী এক নারী। গত ৯ জানুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের রঞ্চন ছৈয়ালকান্দি গ্রামে দুই আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে হোসেন খান (৩২) নামে এক ব্যক্তি নিহত ও ছয়জন আহত হয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর