শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মেগা প্রকল্পে বদলে যাবে দেশ

সাঈদুর রহমান রিমন

মেগা প্রকল্পে বদলে যাবে দেশ

দেশের যোগাযোগ খাতের ছয় মেগা প্রকল্পসহ ১৪টি বৃহৎ প্রকল্পের উন্নয়ন তৎপরতায় বদলে যাচ্ছে দেশ। এর মধ্যে পদ্মা সেতুসহ একাধিক প্রকল্পের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতিতে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবর্তনের এ হাওয়া বইছে দেশজুড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, বাড়বে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি। পুরোদমে এগিয়ে চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। পাশাপাশি মেট্রোরেলের লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সমীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে মেট্রোরেলের আরও কয়েকটি রুট। যানজট নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হওয়ায় সব মহলে স্বস্তি এসেছে। বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অগ্রগতিও সন্তোষজনক। চীন-বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজও উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চীন আগ্রহ প্রকাশ করায় কাঙ্ক্ষিত প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরুর প্রাথমিক পর্যায় শেষ হয়েছে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু : পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ হচ্ছে মোট পাঁচটি প্যাকেজে। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় সেতু এলাকায় নদীর দুই তীরে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এ বাঁধই টিকিয়ে রাখবে সেতুটিকে। তবে নদীশাসনের কাজ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ কাজ শেষ হয়েছে ২৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

কর্ণফুলী টানেল : গত বছরের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিং। তবে জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ না হওয়ায় নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। দু-এক মাসের মধ্যেই কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্পে মোট খরচ হবে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।

মেট্রোরেল : গত বছরের ২৬ জুন যোগাযোগ খাতের দুটি বড় প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে একটি মেট্রোরেল, অপরটি বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। রাস্তার মাঝ বরাবর ওপর দিয়ে উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর-ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে এ মেট্রোরেল। প্রতি ৪ মিনিট পর পর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে ছুটে চলবে এ রেল। ঘণ্টায় চলাচল করবে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী। মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন হবে উত্তরা  (উত্তর), উত্তরা (সেন্টার), উত্তরা (দক্ষিণ), পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, হোটেল সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক এলাকায়। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যার ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা দেবে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকা। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগাবে সরকার।

বিআরটি : ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত সহজ করতে সরকার বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সংরক্ষিত লেনের মাধ্যমে উভয় দিকে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পারাপার করা যাবে। প্রতি তিন মিনিট পর পর স্টেশন থেকে বাস ছাড়বে। প্রকল্পটি হবে গাজীপুর টার্মিনাল থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত। ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি রুটে থাকবে ২৫টি স্টেশন। নির্মাণ করা হবে ছয়টি ফ্লাইওভার। উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার থাকবে এলিভেটেড বিআরটি লেন। ১৬ কিলোমিটার থাকবে সমতলে। ১৮ মিটার দীর্ঘ ১২০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে। বাসগুলোয় ভাড়া আদায়ে থাকবে ইলেকট্রনিক স্মার্টকার্ড। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে পুরোদমে। তিন পর্বে বিভক্ত নির্মাণ কাজের প্রথম অংশ এয়ারপোর্ট থেকে বনানী পর্যন্ত আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। নগরবাসীর যানজটের ভোগান্তি লাঘবে সরকার ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা (সংশোধিত প্রকল্প) ব্যয়ে রাজধানীর সড়ক, বিশেষ করে রেললাইনের ওপর দিয়ে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রুট নির্ধারিত হয়েছে বিমানবন্দর থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-সাতরাস্তা-মগবাজার রেল করিডর-খিলগাঁও-কমলাপুর-গোলাপবাগ এবং কুতুবখালি পর্যন্ত।

ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের পাশে আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে বা নতুন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলবে। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানো যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় প্রকল্প পরিচালক বলেন, পুরো সড়কটির চট্টগ্রাম-ফেনী ও দাউদকান্দি-ঢাকা অংশে কোথাও মাটির ওপর, আবার কোথাও উড়ালসড়ক তৈরি করা হবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র : পাবনার ঈশ্বরদীতে ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে সরকার ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ব্যয় করবে। এর বাইরে রাশিয়ার প্রকল্প সাহায্য রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ পুরোদমে চলছে।

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর : কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্প এটি। ৫০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প তিন ধাপে বাস্তবায়নের সময়কাল ২০১৫ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত।

পায়রা বন্দর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রমে যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে, এতে আগামী বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

মৈত্রী সুপার থারমাল বিদ্যুৎকেন্দ্র : সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণের জন্য এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। এর মাধ্যমে ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুটি আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র : কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ৬০০ করে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে। প্রকল্প ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই দেবে জাপান। এটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। এর ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে।

এলএনজি টার্মিনাল : গ্যাস সংকট নিরসনে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্দেশ্যে মহেশখালীর উপকূলে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টার্মিনাল হবে। টার্মিনাল থেকে মূল ভূখণ্ডে গ্যাস আনতে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে ৯১ কিলোমিটার পাইপ লাইন।

কক্সবাজার-দোহাজারী-গুনদুম রেলপথ : ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। নতুন সময় তিন বছর এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দেবে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। দুই ধাপে ১২৯ দশমিক ৫৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে।

পদ্মা রেলসেতু সংযোগ : ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প ২০২২ সালে শেষ করতে চায় সরকার। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ২ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে চীন থেকে ঋণ নেওয়া হবে। ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-খুলনা পথে ২১২, ঢাকা-যশোর পথে ১৮৪ এবং ঢাকা-দর্শনা পথে ৪৪ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। এ প্রকল্পের জন্য বাজেটে ৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর