শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্ধ ধানের আড়ত ক্রেতাশূন্য মোকাম

হাওরে দুর্দশা, পড়েছে ফসলহানির প্রভাব

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

বন্ধ ধানের আড়ত ক্রেতাশূন্য মোকাম

সুনামগঞ্জ হাওরে ফসলহানি ঘটার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জেলার ধান ব্যবসার ওপর। ভরা মৌসুম হলেও ধানের আড়তগুলো রয়েছে বন্ধ। আর মোকামগুলো রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাওরের প্রায় শতভাগ ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও কিনতে পারেননি কোনো ব্যবসায়ী। ফলে এ অবস্থা হয়েছে। সূত্র মতে, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কৃষকের ঘরে ফসল ওঠার আগেই বাজারে প্রচুর টাকা লগ্নি করেছেন ব্যবসায়ীরা। কৃষকের ঘরে ধান না থাকায় সেই টাকা ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। এতে পথে বসার জোগাড় হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্যবসায়ী। পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন ধানের মোকামে কর্মরত সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক, কয়েক হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী, ধান পরিবহনের কাজে ব্যবহূত নৌকার মালিক ও শ্রমিকরা। সুনামগঞ্জের সব থেকে বড় ধানের মোকাম ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগরে। জেলায় উৎপাদিত বোরো ধানের বড় একটি অংশ কেনাবেচা হয় এই মোকামে। হাওরের মধ্যে অবস্থিত  মোকামটিতে বড় ৪০টি আড়তসহ ছোটবড় দুই শতাধিক ধানের আড়ত রয়েছে। জানা গেছে, আড়ত মালিকদের নিকট থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কৃষকরা ফাল্গুন, চৈত্র মাসে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন বৈশাখে ধান দেওয়ার শর্তে। কিন্তু হাওরের শতভাগ ফসল তলিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসা থেকে লাভ দূরে থাক, আড়তদাররা লগ্নি করা টাকা ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না। সেই সঙ্গে আড়তের বার্ষিক দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার ভাড়া কীভাবে পরিশোধ করবেন— এটাই এখন তাদের বড় চিন্তা। ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানান, প্রতিবছর বৈশাখ শুরুর পর পর জেলার সর্ববৃহৎ মধ্যনগর ধানের মোকামে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার মণ ধান কেনাবেচা হয়। কৃষকের বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ, পরিবহন, নৌকা থেকে উঠানো নামানো ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকেন ৫/৬ হাজার শ্রমিক। ধর্মপাশার হাওরে আবাদকৃত বোরো ধানের ৯৮ ভাগই পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের পাশাপাশি ধান ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরাও চরম বিপাকে পড়েছেন। গতকাল দুপুরে মধ্যনগরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, জেলার বৃহৎ এই ধানের মোকামের সব আড়ত খাঁখাঁ করছে। বৈশাখের এই সময়ে এসেও এক ছটাক ধান কিনতে পারেননি কোনো ব্যবসায়ী। বেশিরভাগ ধানের আড়ত তালাবদ্ধ। যে দুই একটি খোলা— সেগুলোতে বসে অসল সময় পার করছেন মালিক, শ্রমিকরা। আড়তের ঘাটগুলোতে যেখানে প্রতিদিন দুই থেকে ৩০০ নৌকা লোড আনলোড হতো, সেখানে ধান বোঝাই একটি নৌকাও নেই। মোকামে কর্মরত শ্রমিক আবদুল জলিল বলেন, ‘আড়তে যখন ধান কেনাবেচা হয় তখন প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ৭ থেকে ৮০০ টাকা রোজগার করেন। এই মোকামের কয়েক হাজার শ্রমিক এখন বেকার। অনেকে আবার মহাজনের নিকট থেকে শ্রমের অগ্রিম টাকা নিয়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে চলা যেখানে দায়, সেখানে মহাজনের টাকা শোধ করবেন কীভাবে?’  তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কাজ করে বেঁচে থাকতে চাই। সরকার যদি আমাদের বিকল্প কাজের সুযোগ করে দেয় তবে এই দুর্যোগ থেকে আমরা রক্ষা পাব।’ ধান ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘প্রত্যেক আড়তদারের এলাকা ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় লগ্নি করা। আমরা এখন বেকায়দায়। নিজে চলতে পারছি না, শ্রমিকও খাটাতে পারছি না। কী করব না করব- ভেবে দিশাহারা হয়ে গেছি। এই অবস্থায় সরকার যদি পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নেয় তবে আমাদের চলা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।’ মধ্যনগর আড়তদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মাহবুব হোসেন ফারুকী বলেন, ‘এই অকাল বন্যায় কৃষকের গোলা শূন্য থাকায় আমাদের ধানের আড়ত তালাবদ্ধ। মোটা অঙ্কের টাকা কৃষক ও ফড়িয়াদের নিকট লগ্নি করায় চরম বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিলে এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া সম্ভব।’ সমিতির সাবেক সভাপতি জহিরুল হক বলেন, ‘আমাদের হাতে এখন একটি টাকাও নেই। সব টাকা লগ্নি করা। কিন্তু কৃষক ধান তুলতে না পারায় আড়তগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।’ ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালিব খান বলেন, ‘সারা জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ধর্মপাশা উপজেলায়। শতভাগ ধান তলিয়ে যাওয়ার কারণ কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর