বুধবার, ৩০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বেইলি রোডে গেরিলা যোদ্ধাদের মিলনমেলা

জিল্লুর রহিম দুলাল

বেইলি রোডে গেরিলা যোদ্ধাদের মিলনমেলা

১২ মে ২০১৮। রাজধানীর বেইলি রোডের ২৪ নম্বর বাড়িতে বসেছিল এক মিলনমেলা। অভ্যাগতদের জন্য এ ছিল এক অস্থির, উত্তেজনাময়, আনন্দঘন মুহূর্ত। ভাবাই যায় না, প্রায় অর্ধশতাব্দী পর মানে, ৪৭ বছরের মাথায় মিলিত হয়েছেন বাংলার সেই দামাল ছেলেরা, যারা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে দেশকে স্বাধীন করার মরণপণ শপথ অন্তরে ধারণ করে প্রকম্পিত করে তুলেছিল গোটা ঢাকা শহরকে; বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিল এই বার্তা—সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিনের সেই টগবগে তরুণদের অনেকেরই শ্মশ্রু-গুম্ফ শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে; কপালে এবং চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে কারও কারও। কিন্তু স্ত্রী-পুত্র, নাতি-নাতনি নিয়ে তারা যখন এই মিলনমেলায় সমবেত হলেন, কে বলবে তারা বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন! অন্তরে বিজয়ের গর্ব, দীর্ঘকাল পর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাতের অফুরান আনন্দ, চোখেমুখে খুশির ঝিলিক, যেন সবাই সেই একাত্তরের তরুণ, চিরকালের নওজোয়ান। ঢাকা শহরে গেরিলা যুদ্ধের সেই ক্র্যাক প্লাটুনের কথাই বলা হচ্ছে, যাদের অপারেশন, অ্যাকশন, দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের ঘটনা কিংবদন্তির মতো। এরা সবাই মৃত্যুবিষ পটাশিয়াম সায়ানাইড সঙ্গে রাখতেন। উদ্দেশ্য, অপারেশনে গিয়ে কোনোভাবে ধরা পড়লে কৌশলে শত্রুর ঠোঁটে বিষ লাগিয়ে দাও, তারপর নিজের ঠোঁটে লাগাও, ‘মারো এবং মরো’। এই দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, এমপি। সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বললেন, ’৭১ সালে ঢাকা শহরের মূল অপারেশনগুলো এই ক্র্যাক প্লাটুনের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। ঢাকা শহরের বুকে প্রথম ও শেষ অপারেশনও এই প্লাটুনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। আরও কয়েকটি গ্রুপ এখানে সক্রিয় ছিল। কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের মতো এত খেতাব আর কোনো গ্রুপ অর্জন করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনগুলো সফলভাবে পরিচালনার কারণেই ক্র্যাক প্লাটুনের এত সুনাম এত খেতাব। এ প্রসঙ্গে অতি দুঃসাহসিক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। শুধু অপারেশনই নয়, অপারেশনের পর মাথা সুস্থির রেখে তাত্ক্ষণিক সেই ধ্বংসকাণ্ডের ছবি তুলে নিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের ধীমান সদস্য মুক্তিযোদ্ধা দুলাল। এই একটি ঘটনাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গোটা বিশ্বের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে এ ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল, দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকার কেন্দ্রস্থলে সফল অপারেশন চালিয়ে জান্তা ইয়াহিয়া এবং তার হানাদার বাহিনীর শক্তিভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। ঢাকা শহরের পাওয়ার হাউসগুলোতে পরিচালিত সফল অপারেশনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তড়িৎ প্রকৌশলী শহীদ নজরুল ইসলামকে। তিনিই ছিলেন পাওয়ার হাউস অপারেশনের মূল পরিকল্পনাকারী। হিংস্র আক্রোশে হানাদার বাহিনী পরবর্তী সময়ে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকা শহরের সমস্ত অপারেশন ও অ্যাকশনে সেক্টর-২ এর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ও ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) এর ভূমিকার কথা তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেন। তাদের তত্ত্বাবধান, অনুপ্রেরণা, যুদ্ধের কলাকৌশল নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণদান ব্যতিরেকে এত সফল অভিযান কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। এ ছাড়া ঢাকা শহরের চারটি পরিবারের কথাও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে হাবিবুল আলমদের পরিবার, তড়িৎ প্রকৌশলী শহীদ নজরুল ইসলামের পরিবার, মোহন-দুলালদের পরিবার, পুরান ঢাকার ছক্কা-ফক্কাদের পরিবার। এই বাড়িগুলো ছিল ঢাকা শহরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার এক একটি দুর্জয় ঘাঁটি। থাকা-খাওয়া, বিশ্রাম, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য এই বাড়িগুলো পরম নির্ভরতার সঙ্গে ব্যবহূত হতো। মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারগুলোর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘সব শেষে ফল অব ঢাকা’ অর্থাৎ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকা পুনরুদ্ধারের কথা। সেদিনের ঘটনা কখনোই ভুলব না। মেজর হায়দার এর নেতৃত্বে আমরা অ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে যখন ডেমরার কাছে পৌঁছলাম তখন ১৬ ডিসেম্বরের সকাল হয়ে গেছে। ডেমরায় পাকিস্তানি ডিফেন্স থেকে তখনো মর্টারের গোলা বর্ষণ চলছে। পাকিস্তানি ডিফেন্সকে পাশ কাটিয়ে দুপুর নাগাদ আমরা এসে হাজির হলাম ঢাকার উপকণ্ঠে, মুগদাপাড়ায়। এরপর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মতিঝিলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় আবার থমকে দাঁড়ালাম ডিআইটি ভবনের পুরনো টেলিভিশন স্টেশনের সামনে। তখনো টিভি স্টেশনের ওপর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। বাংলাদেশের ম্যাপ অঙ্কিত একটি পতাকা নিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম ডিআইটি ভবনের একেবারে মাথায়। দ্রুতই পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সে জায়গায় লাগিয়ে দিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমার হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে এলো। ওপর থেকে নেমেই দেখি ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধা সদস্যরা মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে উঁচিয়ে অন্তরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে গগনবিদারী স্লোগান তুলছে : ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’। গর্বে অন্তরটা ভরে উঠল। ফের ওপরের দিকে একনজর তাকালাম। দেখলাম, আমার হাতে লাগানো বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা পত পত করে উড়ছে। ঢাকার শহরের বুকে প্রকাশ্যে লাগানো এটাই হচ্ছে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

সকল ১০টা থেকে দিনব্যাপী এই প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠানে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের স্ত্রী-পুত্র, নাতি-নাতনি মিলে শতাধিক লোকের সমাগম ঘটেছিল। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সহধর্মিণী, মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ প্রেরণাদাত্রী রিনি চৌধুরী। মূলত রিনি চৌধুরী, তার পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি সবাই মিলে অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রম করে গেরিলা যোদ্ধাদের এই দুর্লভ মিলনমেলাটির আয়োজন করেছিলেন।

আনন্দমুখর এই পরিবেশে স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের মেয়ে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম, ক্র্যাক প্লাটুনের হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, গাজী গোলাম দস্তগীর বীরপ্রতীক এমপি ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ। গাজী গোলাম দস্তগীর তার স্মৃতিচারণায় বলেন, সাংগঠনিক ক্ষমতা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও রণচাতুর্যের কারণেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডার করা হয়েছিল। সিদ্ধান্তটি যথার্থ ছিল। সমাবেশে আয়োজকমণ্ডলীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন মকবুল ই এলাহী চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আলম ফতেহ আলী, বাদল ভাই, জিয়াউদ্দিন জিয়া, দুলাল, মাসুদুর রহমান তারেক, ধর্মদর্শী বড়ুয়া, ওয়ালী, আমান, রিজভী, বকুল, মনির, সিরাজ, কামাল এবং আরও অনেকে।

সর্বশেষ খবর