বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পদ্মা

হাসপাতালের অর্ধেক বিলীন, আতঙ্ক

প্রতিদিন ডেস্ক

হাসপাতালের অর্ধেক বিলীন, আতঙ্ক

রাজশাহী, শরীয়তপুর, নাটোরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পদ্মা। জামালপুর ও কুড়িগ্রামে যমুনা-ধরলার ভাঙনও তীব্র আকার ধারণ করেছে। কপোতাক্ষও হয়ে উঠছে আগ্রাসী। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—শরীয়তপুর : পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির অধিকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ চালু রাখা হলেও হাসপাতালে প্রবেশের সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ভয়ে কোনো রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে না।

সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের নতুন ভবনটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে পদ্মায় পড়ে গেছে। পাশের ভবনগুলো নদীর তীরে রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও কোনো রোগী দেখা যায়নি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ভাঙনকবলিতরা বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বাজারের পাকা দোকানগুলো নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে ইট ও রড সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গতকাল ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। বেলা আড়াইটার দিকে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট এলাকা থেকে মুলফত্গঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার স্পিডবোটযোগে ঘুরে দেখেন তিনি। পরে মন্ত্রী সুরেশ্বর লঞ্চঘাট এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, পদ্মার ডান তীর সংরক্ষণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পদ্মার পানি কমলেই নদীর তীরে স্থায়ী বাঁধের কাজ শুরু করা হবে। তিনি ভাঙনকবলিতদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্য নাভানা আক্তার, পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেকুজ্জামান, জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের, পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, সিভিল সার্জন মো. খলিলুর রহমান, পাউবোর শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন, নড়িয়া পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম বাবু রাড়ি, নড়িয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ব্যাপারী প্রমুখ।

মন্ত্রী স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নড়িয়া-জাজিরার পদ্মা নদীর ডান তীরের ৯ কিলেমিটার দীর্ঘস্থায়ী বাঁধরক্ষা প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তত্ত্বাবধানের কারণে এত বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পদ্মার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় চলে এসেছেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরও জানান, ভাঙনকবলিত এলাকাকে দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করার সুযোগ নেই। তবে ইতোমধ্যে ২৮টি আশ্রয় কেন্দ্র ভাঙনকবলিতদের আশ্রয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভাঙনকবলিত সব পরিবারকে খাদ্যসহায়তা হিসেবে চাল দেওয়া হয়েছে। আর পুর্নবাসন সহায়তা হিসেবে টিন ও নগদ টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী জানান, প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধের পাশাপাশি চর ড্রেজিং করে তীর হতে স্রোত মাঝ নদীতে নেওয়া হবে। প্রকল্পের কাজ কেন দেরি হচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একটু সময় লেগেছে। এরপর ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের দরকষাকষিতে আরেকটু সময় চলে গেছে। এখন প্রকল্পের কাজ যে কোনো সময় শুরু হবে।

রাজশাহী : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে প্রতিদিন পানি বাড়ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে চরাঞ্চলের মানুষ। পানির তোড়ে পাড় ভাঙতে দেখে তারা বন্যার আশঙ্কা করছে। যদিও নদীর পানি এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। তবে এভাবে পানি বাড়তে থাকলে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো)। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুখলেছুর রহমান জানান, চীনের একটি নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করেছে ভারত। তবে ওই নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। রাজশাহী পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক জানান, প্রতিদিনই পদ্মার পানি ৩-৪ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার পানি বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। এখন প্রতিদিন পানি বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এখনই পদ্মার বুকে জেগে ওঠা বেশির ভাগ চর তলিয়ে গেছে। এসব চরে মানুষের বসতি না থাকলে গবাদি পশু পালন হতো। পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলে যেসব চরে বসতি রয়েছে সেগুলোয় পানি ঢুকবে।

নাটোর : লালপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবহমান প্রমত্তা পদ্মায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙন না থাকলেও নদীর বাঁ তীর রক্ষায় নির্মিত সিসি ব্লকের ধসে নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে নদীতীরবর্তী নূরুল্লাহপুর গ্রামের মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার জানান, ‘নূরুল্লাহপুর পয়েন্টে ব্লক নদীগর্ভে ধসের খবর শুনেছি। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জামালপুর : জামালপুরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুরু হয়েছে যমুনার ভাঙন। ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও মাদারগঞ্জ উপজেলার যমুনার পশ্চিম তীর জুড়ে ভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। গেল এক মাসের ব্যবধানে শুধু ইসলামপুর উপজেলাতেই একটি পুরো গ্রামসহ ৩ শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বর্তমানে জামালপুরের ইসলামপুরে যমুনার ডান তীর পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে চলছে ভাঙন। প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর, ফসলি জমি। জমি-জিরেত, বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। নদী ভাঙনে ভিটামাটি হারিয়ে তিন গ্রামের কয়েক শ পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক জানান, নদী ভাঙনে তার এলাকায় বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। তারা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। জামালপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানান, জামালপুরে যমুনার ভাঙন প্রতিরোধে ৩৮৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। শিগগিরই এ কাজ শুরু হবে।

ফুলবাড়ী : কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ধরলা ও বারোমাসিয়া নদীর পানি আকস্মিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক দিন ধরে নদীগুলোর পানি বাড়াকমার মধ্যে থাকলেও সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাঙনে ২০টি পরিবারের বাড়িঘর, ধান, পাট, আখের জমি, মসজিদ, রাস্তা ধরলায় বিলীন হয়ে গেছে। ডুবে গেছে ৫০ বিঘা জমির ধান।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্যানুযায়ী গতকাল সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে (ফেরিঘাট পয়েন্ট) ৯৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সাতক্ষীরা : শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে ভয়াবহ নদের ভাঙন শুরু হয়েছে। গতকাল ভোরের দিকে ইউনিয়নের নজরুল সরদারের বাড়ি থেকে গাবুরা হাটখোলা পর্যন্ত আধা কিলোমিটার পাউবো বাঁধ কপোতাক্ষ নদে ধসে পড়ে। এতে জনমনে আতঙ্ক শুরু হয়।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, নদী ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পাউবোকে বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর