বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভিনদেশের বাংলাদেশি

মির্জা মেহেদী তমাল

ভিনদেশের বাংলাদেশি

অলমর জান। বয়স ৩০। তিনি রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের মংড়ু লম্বাঘোনা গ্রামে তার বাড়ি। নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কয়েক মাস ছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আশ্রয় ক্যাম্প বদলে তিনি এখন চট্টগ্রামে। আশ্রয়স্থল শুধু নয়, পাল্টে ফেলেছেন নিজের নাম পরিচয়। রোহিঙ্গা অলমর জান এখন বাংলাদেশি মর্জিনা বেগম। ভিন্ন পথে পাওয়া তার জাতীয় পরিচয়পত্রে এই নামই রয়েছে। বাসা ভাড়া করে আছেন চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২২ জনকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা। কিন্তু বাংলাদেশি পাসপোর্টে  এরা সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ইমিগ্রেশন পুলিশ জানায়, ২২ জনের ওই দলটির কথাবার্তা শুনে তাদের সন্দেহ হয়। ইসলাম ধর্ম মতে নারীরা বিবাহ বৈধ নয় এমন নিকটাত্মীয় ছাড়া কারও সঙ্গে হজ বা ওমরাহ পালন করতে পারেন না। দলে থাকা নারীদের সঙ্গে এমন কোনো পুরুষও ছিলেন না। এ ছাড়া তারা কেউ বাংলায় কথা বলতে পারছিলেন না। সাধারণত রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। তারা প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভোটার বৃদ্ধির জন্য অর্থের বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের দেওয়া হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট পাওয়ার লোভেই রোহিঙ্গাদের নাগরিক করে নিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা। আর সামান্য অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে রিপোর্ট দিচ্ছেন পরিদর্শকরা। এ ছাড়া বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছেন। সেখানে তারা বাংলাদেশি পরিচয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবেই ভিনদেশের মানুষ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি।

গত এপ্রিলে একটি অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। তারা বিদেশে নানা অপরাধে জড়িয়ে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে।

সরকারের কড়া নজরদারি থাকা সত্ত্বেও কিছু দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট না পাওয়ার জন্য সরকারের কঠোর নজরদারি রয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, পুলিশের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে।

বিদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি হিসেবে পরিগণিত হয়। যার কারণে বাংলাদেশের ওয়ার্ক পারমিট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় এসব দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমানে যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশিরা করে থাকে তার মধ্যে ৯৫ ভাগ হলো এই রোহিঙ্গা। এদের দায় বহন করছে বাংলাদেশিরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দেশগুলো বাংলাদেশের ভিসা পারমিট বন্ধ রেখেছে অনেক বছর ধরে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবির বাদে চট্টগ্রামে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। চট্টগ্রাম শহরে ও বিভিন্ন উপজেলায় এদের বসবাস দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তারা কোথাও রোহিঙ্গা পরিচয় দেয় না। তারা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবেই পরিচয় দিচ্ছে। স্থানীয় দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অর্থের বিনিময়ে প্রথমে চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের কাছ থেকে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে। পাসপোর্ট অফিসের দালালরা ও মোটা অঙ্কের টাকায় জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয়তার সনদ টাকার বিনিময়ে অতি সহজে জোগাড় করে দেয়। আর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুলিশি ভেরিফিকেশনও পেয়ে যায় অতি সহজে। যেখানে বাংলাদেশি একজনের পাসপোর্ট বানাতে পুলিশি তদন্তের ছাড়পত্র পেতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে এসব রোহিঙ্গা টাকার বিনিময়ে অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন। পাসপোর্ট ফরমের সঙ্গে যা যা তথ্য-উপাত্ত দরকার সবই পাসপোর্ট অফিসের দালালরা সরবরাহ করে দেয়। যার ফলে পাসপোর্ট অফিসের পরিচালকদের করার কিছুই থাকে না। সংশ্লিষ্ট পাসপোর্টে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এলাকার থানা থেকে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও দালালরা সিটি এসবি বা জেলা এসবি অফিস থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। সূত্র জানায়, যে কোনো উপায়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে তারা ওমরা হজের দিকে ঝুঁকে পড়ে বেশি। ওমরাহ ভিসা নিয়ে তারা আর ফেরত আসে না। বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ভিসা ও লেবার ভিসা নিয়েও তারা মধ্যপ্রাচ্যে গমন করে। সেখানে গিয়ে তারা নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নারী ব্যবসা, মদ, জুয়া, দালালি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইকারী, চিটিংবাজি সব কিছুতে তারা সিদ্ধহস্ত। তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এসব বেআইনি কাজ করছে; যার কারণে বদনাম হচ্ছে বাংলাদেশের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর