শুক্রবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বে-টার্মিনালে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

বদলে যাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চেহারা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বে-টার্মিনালে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল প্রত্যাশিত বে-টার্মিনাল প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। পয়লা নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ২০ হাজার কোটি টাকার এ মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হলো। প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বে-টার্মিনাল হবে বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের তিনগুণ। এখানে ১২ মিটার ড্রাফটের দীর্ঘ জাহাজ ভেড়ানো যাবে। জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা না করে ২৪ ঘণ্টাই জাহাজ ভিড়তে পারবে এই বন্দরে। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে আট মিটারের বড় মাদার ভেসেল ভেড়ানো যায় না। এখানে জাহাজ আনা-নেওয়া জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে যেখানে ১৯টি জাহাজ ভিড়তে পারে সেখানে বে-টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৫টি জাহাজ বার্থিং নিতে পারবে। ফলে বে-টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতির চাকা। বদলে যাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বর্তমান চেহারা-এমনটাই মনে করছেন বন্দর-সংশ্লিষ্টরা। সমীক্ষা অনুযায়ী, হালিশহর উপকূল থেকে প্রায় ৮০০ মিটার দূরে জেগে ওঠা চরের সঙ্গে যে চ্যানেলটি রয়েছে, তার গভীরতা ৭ থেকে ১০ মিটার। সাগরের দিকে এর গভীরতা ১২ মিটারেরও বেশি। অর্থাৎ এই টার্মিনাল দিয়ে ১২ মিটার গভীরতার এবং ২৮০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে। কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান জেটিগুলোতে ৯ দশমিক ৫ মিটার গভীরতা ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না। ২০১৫ সালে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে কাজ করার সময় বে-টার্মিনালের সম্ভাব্যতার কথা তুলে ধরে। মূলত এর পর থেকেই এ টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জার্মানভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরপরই বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমে এখানে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে মাটি ভরাটের মাধ্যমে দৃশ্যত এর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ শেষে জেলা প্রশাসন থেকে বুঝে পেয়েছি। পর্যায়ক্রমে বাকি সরকারি খাসজমি অধিগ্রহণ করা হবে। ২০ হাজার কোটি টাকার বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চেহারাই পাল্টে যাবে।’ বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৯০৭ একর জমির মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৭ একর জমি পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেনের কাছে ওই জমির দাম বাবদ ৩৫২ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করেছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৬৮ একর ভূমি বুঝে পাওয়ার পর তারা টার্মিনালের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু করেছে। এ কাজ বছরখানেকের মধ্যেই শেষ করা যাবে। কোনো জটিলতা না থাকলে ২০২২ সালের মধ্যে জেটি নির্মাণসহ পুরো প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে পারে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে ২.৮ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার ইউনিটস)। বে-টার্মিনাল চালু হলে শুধু এই এক টার্মিনালের মাধ্যমেই এক অর্থবছরের পণ্য হ্যান্ডলিং করা যাবে তিন মিলিয়ন টিইইউএস। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতার চেয়েও তিন থেকে চারগুণ বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং হবে এ টার্মিনালে। এদিকে পণ্য ওঠানামার ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে ‘বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প’ প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প (ফাস্ট ট্র্যাক) তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দর চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ ভূমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের প্রচলিত আইনে ভূমি অধিগ্রহণ একটি কঠিন কাজ। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রকল্পটি এত দিন আটকে ছিল। তবে এ কাজে এরই মধ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রস্তাবিত ৯০৭ একর ভূমির মধ্যে ৮৩৯ একর সরকারি খাস ও ৬৮ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি আমরা বুঝে পেলেও সরকারি খাসজমি অধিগ্রহণের কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রকল্পটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। আশা করছি শিগগিরই সরকারি খাসজমির বন্দোবস্তও পাওয়া যাবে।’

এদিকে বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি ৮৩৯ একর সরকারি খাসজমি বন্দরের নামে বন্দোবস্ত দিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হয়েছে। তবে এ বাবদ বন্দরকে খরচ করতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু বন্দর চায় প্রতীকী মূল্যে জমি বরাদ্দ পেতে। বিষয়টি নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকও হয়েছে। তবে প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দের জটিলতাও রয়েছে। প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দিতে পারেন শুধু প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রাম বন্দরের উপব্যবস্থাপক (ভূমি) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু বে-টার্মিনাল দেশের প্রয়োজনে হচ্ছে, তাই আশা করছি এর জন্য যে পরিমাণ সরকারি খাসজমির প্রয়োজন হবে, তা প্রতীকী মূল্যে বন্দরকে দেওয়া হবে।’

অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০ হাজার কোটি টাকার বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও এর অপারেশনাল কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে চীন ও ভারতকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেছে সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি। দেশটির রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ) প্রস্তাবিত টার্মিনাল নির্মাণ ছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদে এটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) যদি জমির মালিক হয়, তবে পিএসএ দীর্ঘ মেয়াদে টার্মিনাল অপারেশনের চুক্তিতে যেতে আগ্রহী। আর চবক যদি জমির মালিক ও টার্মিনাল অপারেটর হয়, তবে তারা জয়েন্ট ভেঞ্চারে অপারেশনের কাজটি করতে আগ্রহী। সূত্র জানায়, সম্প্রতি কোম্পানিটির একটি টিম ঢাকায় এসে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রস্তাবনা নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে গেছে, যেখানে বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও অপারেশনাল কার্যক্রম বিষয়ে সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনা ছিল। উপরন্তু প্রকল্পটি নির্মাণের পাশাপাশি এটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে সেই অর্থ ‘সহজ শর্তের ঋণ’ হিসেবে সংগ্রহ এবং তা দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের সুযোগের বিষয়েও নিশ্চয়তা দিয়েছে পিএসএ। আর এই বিষয়টিই চীন ও ভারতের কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের চেয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটিকে এগিয়ে রেখেছে।

সর্বশেষ খবর