মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভাসতে ভাসতে অতিথিসেবা

মাহবুব মমতাজী

ভাসতে ভাসতে অতিথিসেবা

লাগসই সেবার জোগান দেওয়ার ব্যবসা নানা কায়দায় চলে। এরকম একটি ব্যবসা হলো ভাসমান অতিথিদের সেবাদান। নদীতে ভেসে আছে অথচ চলমান নয়, এরকম নৌকায় মানুষকে পয়সার বিনিময়ে খেতে ও থাকতে দেওয়ার ব্যবসাটি ঢাকা নগরীর ঐতিহ্যেরই অংশ। আধুনিকতায় যাকে বলা হয় ভাসমান হোটেল। তার সূচনা মুঘল আমলে। নিম্ন আয়ের মানুষের রাতযাপনের উপযোগী ঠাঁই ভাসমান হোটেল। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও বুড়িগঙ্গায় ৫০-৬০টি ভাসমান হোটেল ছিল। দিন দিন সংখ্যা কমেছে। উমা উজালা, বুড়িগঙ্গা, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর মুসলিম- এই চারটি ভাসমান হোটেল আজও চালু আছে বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজঘাটে। এসব হোটেলে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১০০ টাকা, আর ডাবল কেবিনে ১৫০ টাকা। এখানেই সন্ধান মিলল যারা বছরের পর বছর ধরে ভাসমান দুই অতিথি। এদের একজন প্রায় ৪৭ বছর ধরে ভাসমান হোটেলে বাস করছেন। নাম মহিবুল ইসলাম। আরেকজন জুলফিকার, তিনি আছেন ২১ বছর ধরে। জানা গেল, গত শতকের সত্তরের দশকেও জমজমাট ছিল এই হোটেলগুলো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ীদের অনেকে এসব হোটেলে রাতযাপন করতেন। তাদের অনেকেই ঢাকা শহরের কোনো মুসলিম হোটেলে খাবার খেতেন না, রাতযাপনও করতেন না। তাই তাদের সুবিধার জন্য কিছুসংখ্যক হিন্দু ব্যবসায়ী কাঠের তৈরি নৌযানকে কাজে লাগিয়ে এসব ভাসমান হোটেল তৈরি করেন। তবে সেই হিন্দু মালিকরা এখন আর নেই। স্বাধীনতার পর তা মুসলমান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। ভাসমান হোটেলগুলো কাঠের বদলে লোহায় বানানো হয়েছে। আর ঘাটে রাখা বাবদ মাস শেষে নির্দিষ্ট ভাড়া দিতে হয় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষকে। সরেজমিন দেখা যায়, ফরিদপুর মুসলিম হোটেলে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে কিছুক্ষণ স্টিলের সরু পথ দিয়ে হাঁটতে হবে। তারপর দেখা মিলবে বাঁশ ও কাঠের তৈরি অভ্যর্থনা টেবিল। তবে কাঠের তৈরি হোটেলের বেশির ভাগ জানালাই উন্মুক্ত। প্রতিটি কক্ষেই আছে একটি খাট, বালিশ, কাঁথা ও ফ্যান। এখানেই প্রায় ৪৭ বছর ধরে আছেন মুহিবুল ইসলাম।

তার বাড়ি শরীয়তপুরে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তিনি কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। কিন্তু কোনো কাজ না পেয়ে সদরঘাট টার্মিনালে পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরপর থেকেই এই হোটেলের নিয়মিত বাসিন্দা হয়ে যান তিনি। মুহিবুল বলেন, সত্তরের দশকে ওয়াইজঘাটের এসব ভাসমান হোটেলে খাবারের বিল পরিশোধ করলেই রাতযাপন করা যেত। কোনো ভাড়া নেওয়া হতো না। মাছ, ভাত বা মাংস, ভাত যা খাওয়া হোক, খরচ ছিল কম। এখন খাওয়ার খরচ প্রতি বেলা ৬০-৮০ টাকা। আর থাকার জন্য দিতে হয় ১০০ টাকা। তারপরও এ হোটেলের মায়া ছাড়তে পারি না। জুলফিকার দিনে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় কাজ করেন। আর রাতে একই হোটেলে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো লোকের রাইতে থাকার জন্য একমাত্র ভরসা এই ভাসমান হোটেল। এহেনে থাকতে অনেক ভালো লাগে। কোনো সমস্যা হয় না।’ ডতন তলাবিশিষ্ট এ হোটেলে কক্ষ আছে প্রায় ৫০টি। প্রতিটি কক্ষে আছে ফ্যান। ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, শীতের মৌসুম, ঈদ ও পূজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় আসেন। তখন সব কক্ষ ভাড়া হয়। তবে এসব হোটেলে ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, ফল ব্যবসায়ীরাই বেশি থাকেন। হোটেলগুলো টিকে থাকলেও আগের ঐতিহ্য আর নেই। কমে গেছে হোটেলে অতিথির সংখ্যা। এখন মানুষ হোটেল দেখার আগে সাজসজ্জা দেখেন। ভাসমান হোটেলে তো আর এসব নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর