বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রবাসী নারীর সাহিত্যচর্চা ও বইমেলায় বই

মনিজা রহমান

‘একজন পুরুষ লেখককে তার পরিবার যেভাবে অবসর তৈরি করে দেয়। একজন নারী লেখককে সেটা দেয় না।’ কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের প্রতিভাবান লেখক নাসরিন জাহান। বিদেশে এ কথাটা আরও সত্যি। কারণ এখানে একজন নারীকে কাজ করতে হয় দশভুজা দুর্গার মতো। অধিকাংশ প্রবাসী নারী বাইরে কাজ করেন। আট-দশ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রমের পরে তাকে ঘরে ফিরে ঘরের সব কাজ করতে হয়। তদুপরি সন্তানের লালন-পালন, তাদের স্কুলে আনা-নেওয়া, হোমওয়ার্কে সাহায্য, সপ্তাহান্তে নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া তো আছেই। এর মধ্যেও অনেক মেয়ে লিখছেন। প্রথমে হয়তো ফেসবুকে লেখালেখির সূচনা হয়। তারপর যখন ভালো সাড়া পেতে থাকে তখন সে লেখালেখির বিষয়ে আরও মনোযোগী ও সচেতন হয়। এক সময় সিরিয়াস লেখকে পরিণত হয়। তারপর বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্টেটে বসবাসরত এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকায় অনুষ্ঠানরত এবারের অমর একুশে বইমেলায়। অনেক লেখক উঠে আসাকে ইতিবাচক চোখে দেখেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক পূরবী বসু, ‘আমি তাদের লেখাতে সম্মিলিত কণ্ঠ শুনতে পাই। যত পথ, তত মতে বিশ্বাসী আমি। নানা রকম লেখার মাধ্যমে সেরাটা উঠে আসে। চেষ্টাটা কল্যাণকর।’ তবে তিনি এও যুক্ত করেন, ‘প্রতিনিয়ত নিজের উত্তরণের জন্য চেষ্টা করতে হবে। এজন্য প্রচুর অনুশীলন দরকার। সামান্য লেখালেখি করেই বই বের করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়। নিজেকে আরও তৈরি করতে হবে।’

বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসে প্রবাসে বেশির ভাগ নারী স্বাবলম্বী হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়। জীবন সম্পর্কে নতুন করে উপলব্ধি জন্মে। নতুন স্থান, নতুন মানুষের সঙ্গে চেনা-জানা হয়। যেটা তাদের মানস গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলে। তাদের এই নতুন দেখাকে তারা লিপিবদ্ধ করতে চায় লেখাতে। শুরুতে ছোট ছোট ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে হয়তো শুরু হয়। তারপর সেটা বিস্তার লাভ করে। কেউ কবিতা লেখে, কেউ গল্প লেখে, কেউ কলাম, আবার কেউ ফিচার।

প্রতিবাদী কবি আলেয়া চৌধুরী মনে করেন, যে কোনো লেখাতে মানুষের কথা, জীবনের কথা থাকলে সেটা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবেই। ‘আমি কখনো লেখক হিসেবে নিজেকে অভিজাতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ভাবিনি। আমি চেয়েছি মানুষের কথা বলতে। আমি নিজেকে হারলেমের মেয়ে দাবি করেছি। সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা না লিখলে সেটা আমার কাছে কোনো সাহিত্য নয়।’ তিনি এরপর যুক্ত করেন, ‘লেখাকে সর্বস্তরের পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বই বের করা জরুরি। ফেসবুকের লেখাপড়ার সুযোগ সবার হয় না। আর সেটা একদিন পরে ওয়াল থেকে হারিয়ে যায়। বই চিরন্তন। বই মানুষকে অমরত্ব দেয়।’ ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলায় প্রবাসী নারী লেখকদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে। সিনিয়র সাংবাদিক ও আজকালের সম্পাদক মনজুর আহমেদ এই নিয়ে বলেছেন, ‘এই কয়েক বছর আগেও আমরা পত্রিকায় লেখার জন্য এখানকার লেখকদের খুঁজে পেতাম না। কিন্তু কয়েক বছরে যেন একটা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এখন যেন প্রতিনিয়ত নতুন লেখক উঠে আসছে। এদের মধ্যে মেয়েদের চেষ্টাটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তারা খুব সিরিয়াস লেখালেখির বিষয়ে।’ নিউইয়র্কে একটি পাবলিক স্কুলে সহকারী শিক্ষিকার কাজের পাশাপাশি সময় পেলেই লিখতে বসে যান রোমেনা লেইস। নিজের বই প্রকাশের অনুভূতি নিয়ে বলেন, ‘স্বপ্ন সেটাই যেটা আমরা জেগে থেকে দেখি। ঘুমিয়ে দেখলে তা স্বপ্ন নয়। ২০১৭ আমার স্বপ্ন পূরণের বছর। কারণ ওই বছর অমর একুশে বইমেলায় আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয়। অয়ন প্রকাশন থেকে ‘ভালোবাসার রঙ নীল’। চৈতন্য প্রকাশনী থেকে ‘মেঘের দেশে মেঘবালিকা’ ও ‘চন্দনী’। চন্দনী আমার আর আমার ছোট বোন রুনা লেইসের যৌথ গল্পগ্রন্থ।’ কেন বই লেখেন জানতে চাইলে রোমেনা লেইস বলেন, ‘শিশুবেলায় লেখা প্রথম বই তিয়াপা, বরাকা ও রকেট। মনের মধ্যে একটা চিত্রকল্প তৈরি হয় বইটি পড়ে। সেই থেকে নতুন বইয়ের গন্ধে মন যেন কেমন করে। একটি নতুন বই সন্তানের মতো। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে, বুকে তুলে নিলে যেমন অনুভূতি হয়, একটি নতুন বই প্রকাশিত হলে আমারও তেমন অনুভূতি হয়। ২০১৭ সালের পরে ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় আমার বই ‘মিতুলের বন্ধু বটগাছের ভূত’। এ বছর অয়ন প্রকাশন থেকে এসেছে আমার গল্পগ্রন্থ ‘ঘুঙুর’।’ ডেনভারে বসবাসরত কথা সাহিত্যিক পূরবী বসু শারীরিক প্রচ  অসুস্থতার মধ্যেও এই বছর কয়েকটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী বই-‘আলোকিত সহোদরা’। লেখক এখন একই মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত বোনদের নিয়ে লিখেছেন। এমন গ্রন্থ বাংলা ভাষায় আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি। সফল ও খ্যাতিমান বাঙালি সহোদরা তাঁদের নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে এই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। এখানে কেবল তাদের ব্যক্তিগত অর্জন বা সাফল্যের কথাই নয়, সমাজ উন্নয়নে তাদের বহুমাত্রিক অর্জনের কথাও বলা হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে পুথিনিলয়। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের আরেকটি বই-‘রোকেয়া ও রবীন্দ্রনাথ কাছে থেকেও দূরে’। এ ছাড়া বর্ণ প্রকাশ লিমিটেড থেকে ‘আখ্যান কবিতা’ এবং ‘পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে বের হয়েছে ‘যে পালাতে চায় সে হারায়’ গল্পগ্রন্থটি। আশির দশকের বাংলাদেশের নামকরা কবি ও উপস্থাপিকা শামীম আজাদ দীর্ঘদিন হলো লন্ডনে বাস করছেন। সিলেটী বয়ানে লেখা তাঁর বই ‘কইন্যা কিচ্ছা’ প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশন। শামীম আজাদের মতোই কানাডা প্রবাসী আরেক বিখ্যাত লেখক নাহার মনিকা। এ বছর তাঁর উপন্যাস ‘মন্থকূপ’ ও গল্পগ্রন্থ ‘দখলের দৌড়’ প্রকাশিত হয়েছে। দুটি বইয়ের প্রকাশক বৈভব ও প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।

এবার আসা যাক নিউইয়র্কের লেখকদের আলোচনায়। এই শহরের জনপ্রিয় লেখক পলি শাহীনার বই হৃৎকথন প্রকাশ করেছে অন্বয় প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। এই শহরের আরেক জনপ্রিয় লেখক রিমি রুম্মানের বই অনুভূতির আকাশে তারার মেলা প্রকাশ করেছে সূচীপত্র। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাগীব আহসান। নিউইয়র্ক প্রবাসী তরুণ কথাসাহিত্যিক স্মৃতি ভদ্রের লেখা অন্তর্গত বিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ প্রকাশ করেছে পেন্সিল প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ। সাংবাদিক মনিজা রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘অশুভকাল’ও প্রকাশিত হয়েছে পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে। প্রচ্ছদ করেছে নির্ঝর নৈঃশব্দ। যোগব্যায়াম আর্টিস্ট ও মিডিয়া কর্মী আশরাফুন নাহার লিউজা অবসরে কবিতাও লেখেন। তাঁর নতুন কবিতার বই ‘নিবেদিতার নীল চোখ’ প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর