বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা

রাজবাড়ী হাসপাতালে শত নেইয়ের মাঝে আছে শুধু দুর্নীতি

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

গোয়ালন্দ থেকে দরিদ্র ভ্যানচালক হাসেম মৃধা তার চার বছর বয়সী শিশুকন্যা তাছরিনকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। হাসপাতালে আনার পর দালাল চক্র ঘিরে ধরে তাকে। ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই এমন কথা বলে তাদের পাশের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায় দালাল চক্রের একজন। সদরের হাবাসপুর এলাকা থেকে হাজেরা বেগম পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। তাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখার পর কোনো সেবা দেওয়া হয়নি। এক মহিলা দালাল হাজেরা বেগমকে একরকম জোর করেই নিয়ে যান অন্যখানে। হাসপাতালে আসা রোগীদের এমনিভাবে ক্লিনিকগুলোতে নিয়ে যায় দালাল চক্র। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য এটি। হাসপাতালজুড়ে দালাল চক্রের এমন উপস্থিতি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। রাজবাড়ীর একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভাড়াটে কর্মী এসব দালালের সঙ্গে যোগসূত্র আছে হাসপাতালের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর। ১২ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে যে জনবল ও যন্ত্রপাতির দরকার, তার তেমন কিছুই নেই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে। হাসপাতালজুড়ে কেবলই আর্তনাদ-নেই আর নেই। হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। এরপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বন্ধ রাখা হয়েছে জরুরি সেবা কার্যক্রম। কোনো কারণ ছাড়াই ২০০৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতর ‘জরুরি বিভাগ’টি বন্ধ করে দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছে ‘জরুরি বিভাগ’। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির মহাসাগরে নিমজ্জিত রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক চক্র হাসপাতালটিকে জিম্মি করে রেখেছে। ওই চক্রের কবলে পড়ে রুগ্্ণ থেকে অতি রুগ্্ণ অবস্থায় যাচ্ছে হাসপাতালটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো সেবাই মেলে না এ হাসপাতাল থেকে। রোগীর স্বজনরা কোনো উচ্চবাচ্য করলেই উন্নত চিকিৎসার অজুহাতে স্থানান্তর করা হয় ফরিদপুর কিংবা ঢাকায়। ফলে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা মুখ বুজেই পড়ে থাকেন সেখানে। সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হন দরিদ্র রোগীরা। সেবা তো মেলেই না, মেলে না ওষুধও। হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই। সিন্ডিকেটের কারণেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ টুঁশব্দটি করেন না বলে জানান অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচটি উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৬৯ সালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ৪২টি পদের বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ১৭ জন। খাতা-কলমে ১৭ জন থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ছুটিতে আছেন দুজন। যারা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আছেন তারাও ঠিকমতো ডিউটি করেন না। বেলা ২টা বাজলেই হাসপাতালে চিকিৎসকের দেখা মেলা কষ্ট। বিভিন্ন ক্লিনিকে তারা সময় দেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালটির কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছেন, যারা ফরিদপুরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখেন। জানা গেছে, হাসপাতালটিতে সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), সিনিয়র কনসালটেন্ট  (মেডিসিন), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিকস), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি),  জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), মেডিকেল অফিসার, সহকারী সার্জনসহ সমমানের নয়জন, একজন প্যাথলজিস্ট, মেডিকেল অফিসার পদগুলো শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া দুই চিকিৎসক নার্গিস সুলতানা ও মাকসুদা আক্তার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি কর্মচারীদেরও পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে সেবা তত্ত্বাবধায়ক, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, দুজন সহকারী সেবক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী, ক্যাশিয়ার, স্টেনোটাইপিস্ট, কম্পিউটার অপারেটর, ওয়ার্ড মাস্টার, টিকিট ক্লার্ক, রেকর্ডকিপার, রিসিপশনিস্ট, লিলেন বিপার, ডোম, জেনারেটর অপারেটর, ডকরুম সহকারী, ওটি বয়সহ একাধিক পদ শূন্য রয়েছে। হাসপাতালটিতে নেই আর নেইয়ের মধ্যে আছে শুধুই লুটপাট-এমন অভিযোগ স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালটিকে পুঁজি করে শক্তিশালী একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে রোগীদের বরাদ্দকৃত খাবারের টাকা। অতিরিক্ত রোগী দেখিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। হাসপাতালের বিনামূল্যের ওষুধ নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। দালাল চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী হাতিয়ে নেওয়াও এই চক্রটির কাজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, দুর্নীতি আর অনিয়ম বাসা বেঁধে আছে হাসপাতালটিতে। দিনের পর দিন এমনটি চললেও দেখার কেউ নেই। হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যেন একটি চক্রের কাছে জিম্মি। চিকিৎসক সংকট আর যন্ত্রপাতি নেই এমন দোহাই দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী ও তাদের স্বজনদের অন্যত্র যেতে বাধ্য করে। হাসপাতালের পরিবেশ একেবারেই নোংরা। যে কয়টি টয়লেট রয়েছে সেগুলো একরকম অকেজোই বলা চলে। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা শতাধিক হলেও মাঝেমধ্যে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে শীতের মধ্যে রোগীদের হাসপাতালের বারান্দায় থাকতে হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘জেলার মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে যে লোকবল দরকার তার অর্ধেকও নেই। এ ছাড়া জরুরি বিভাগটি ১৫ বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জরুরি বিভাগটি আমরা চালু রেখেছি। আলট্রা ও ডেন্টাল বিভাগে কোনো যন্ত্রপাতি নেই। ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি একেবারেই অকেজো। কয়েক মাস আগে চারজন ডাক্তারের পোস্টিং দেওয়া হলেও তারা তদবির করে এখানে আসেননি। খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে খাবার সাপ্লাই টেন্ডার বন্ধ রয়েছে। আদালতের নির্দেশের কারণে টেন্ডার করা যাচ্ছে না। বিগত দিনে যারা খাবার সাপ্লাই দিতেন তারাই সাপ্লাই দিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর