শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডাক্তার থাকার কথা ৩৬ জন আছেন ৮

তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা
পঞ্চগড় সদর হাসপাতাল

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

শহরের জালাসী এলাকার হাসান আলী হঠাৎ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলে বিকালের দিকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। সেদিন সারারাত পেটের পীড়ায় ছটফট করলেও সেবিকা ছাড়া কোনো ডাক্তারের মুখ দেখেননি তিনি। পরদিন সকালে ডাক্তার এলেও চিকিৎসায় খুশি নন তিনি। হাসান আলী জানান, ‘হাত নেড়েচেড়ে দেখে কী একটা ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেছেন ডাক্তার। তাই খাচ্ছি। পেটের পীড়া এখনো কমেনি।’ সরেজমিনে ঘুরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে ‘অন্যান্য সেবার মান মোটামুটি’ বলে জানা গেলেও রোগীদের প্রধান অভিযোগ ডাক্তারদের প্রতি। তারা বলছেন, সময়মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার চিকিৎসা না দিয়ে অন্য ডাক্তাররাও অনুমাননির্ভর চিকিৎসা দিচ্ছেন। ফলে রোগীদের রোগ সারা তো দূরের কথা- কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসার শিকার       হতে হচ্ছে। রোগীদের এসব অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়ে হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ক জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মনসুর আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ভয়ানক চিকিৎসক সংকট রয়েছে এই হাসপাতালে। ৩৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা। আছেন মাত্র ৮ জন। এর মধ্যে একজন রংপুর মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত আছেন। জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের ৪ জন ডাক্তারকে প্রেষণে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আউটডোরে সার্ভিস দেওয়ার মতো রাউন্ড ব্লকে ৪ জন ডাক্তার রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন আর এমও। প্রোপার চিকিৎসার জন্য এটা একদমই পর্যাপ্ত নয়। সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের সহযোগী প্রয়োজন। কিন্তু এখানে কর্মকর্তা, কর্মচারীর ভীষণ সংকট রয়েছে। সহযোগী ছাড়া কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এতে চিকিৎসকদের মনও বিঘ্নিত হয়। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। এই হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী মাত্র ৪ জন। কাজ করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে জটিলতাও আছে। প্রতিদিন এই হাসপাতালে ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। ১০০ বেডের হাসপাতালে ১২০ থেকে ১৫০ রোগী নিয়মিত ২৪ ঘণ্টা সেবা নিচ্ছেন। পাঁচ উপজেলার ১০ লাখ মানুষের প্রধানতম এই হাসপাতালে অন্তত ১৫ জন নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীর প্রয়োজন। গত সরকারের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান ১ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে বেতন দিয়ে বেসরকারিভাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বর্তমানে ওই স্বাস্থ্য কর্মীর বেতন বন্ধ আছে। ৩০ তারিখের নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধানকে তিনি এ ব্যাপারে মৌখিক অবগত করেছেন। আপাতত কয়েকমাস থেকে দুজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন তারা। ওই দুই পরিচ্ছন্নতা কর্মীর বেতন দিচ্ছেন এই হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। চিকিৎসক ১০০ টাকা, নার্স ৭৫ টাকা, তৃতীয় শ্রেণি ৫০ টাকা এবং ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীরা ২০ টাকা হাড়ে চাঁদা দিয়ে তাদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে। ডা. মনসুর বলেন, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক পদে কেউ নেই। তত্ত্ববধায়কের দায়িত্ব অনেক। ফলে সিভিল সার্জনকেই তত্ত্বাবধায়কের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ কারণে তিনি উপজেলা বা স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রগুলোতে ভিজিটে যেতে পারেন না। মূলত জনবল সংকটটিকে প্রধানতম সংকট বলে উল্লেখ করে ডা. মনসুর বলেন, অভিজ্ঞ জনবল হলে এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় বিরাট পরিবর্তন ঘটবে। হাসপাতালের অন্য আরও কয়েকজন রোগী জানান, দালালের উৎপাত আছে। আছে রিপ্রেজেনটেটিভদের টেবিলে টেবিলে আনাগোনা। অনেকে বিনামূল্যে ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগও করেন। চিকিৎসকদের ক্লিনিক প্রীতিও রয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী একে এম আনোয়ারুল ইসলাম খায়ের জানান, চিকিৎসকের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে হাজার হাজার রোগীকে যেতে হচ্ছে দিনাজপুর, রংপুর অথবা ঢাকায়। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার পর এই জেলার একটি বড় অংশের মানুষ ভারতের শিলিগুড়ি, কলকাতা, ভ্যালোর, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন শহরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। শীতে প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে এই এলাকার শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে নানা রোগ দেখা দেয়। বলতে গেলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কোনো সেবাই পাচ্ছে না এ হাসপাতালে। বছরে পর বছর ধরে এমনই চলছে। তবু আশার বাণী শোনান সিভিল সার্জন কাম তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে সেবা দেওয়ার  প্রস্তুতি কেমন রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে সবসময় প্রস্তুত আছি। সংকট ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সমস্যার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে। এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট, চিকিৎসকসহ লোকবল লাগবে। সেইসঙ্গে আধুনিক সদর হাসপাতালটিকে কম পক্ষে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করতে হবে।’

 

 

সর্বশেষ খবর