রবিবার, ১০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্মৃতির মলাটে মিলনমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

নাসিমুল হুদা, ঢাবি

স্মৃতির মলাটে মিলনমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ দিনের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে হাজির হাজার খানেক নানা বয়সী মানুষ। হাসি, গান আর আড্ডায় মেতে ওঠেছেন তারা। বয়স, পদ আর সামাজিকতার বেড়াজাল ভেঙে কেউ করছেন ছেলে মানুষী আনন্দ উল্লাস, কেউ করছেন হৈচৈ আর কেউ বা দল বেঁধে গলা মেলাচ্ছেন গানের আসরে।

এভাবেই দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনেরা গতকাল দিনভর কাটিয়েছেন। আর কিছুদিন পরেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য অবদান রাখা এই বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা রাখতে যাচ্ছে। তাই ‘শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের এই মিলনমেলা আয়োজন করে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয় মনোরম সাজে। সকাল থেকেই প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে তাদের স্মৃতি বিজরিত ক্যাম্পাস। নজরুল সংগীত শিল্পী সুজিত মোস্তফার ‘অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারী’ গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপরই একে একে গান আর নৃত্য পরিবেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে চলতে থাকে প্রাক্তনদের আড্ডাবাজি। তারা হারিয়ে যান নিজেদের যৌবনের প্রাণোচ্ছলতায়। ক্যাম্পাসের ফেলে আসা সেই রঙিন জীবনকে খুঁজে ফেরেন তারা। টিএসসির আড্ডা, দুরন্তপনা অথবা আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলো তাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। দিনভর আনন্দ-উল্লাস, ছবি তোলা, বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, হৈচৈ ও কোলাহলে মেতে থাকেন সবাই।

জাতীয় সংগীতের সুরের মূর্ছনায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মিলনমেলার বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। একই সময় উত্তোলন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বেলুন উড়িয়ে মিলনমেলার উদ্বোধন করেন। নীল আকাশে মৃদু বাতাসের দোলা লাগা সেই বেলুনের মতোই প্রাক্তন ঢাবি শিক্ষার্থীদের মনও নেচে ওঠে আনন্দে। ব্যান্ডপার্টির ঢোলের তালে নাচতে শুরু করেন কেউ কেউ। এরপর নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দ্র মজুমদারের সঞ্চালনায় শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মনজুর এলাহী, রকীব উদ্দীন আহমেদ, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার, মিলনমেলা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওছার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদসহ সাবেক উপাচার্যরা, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, শিল্পপতি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বক্তব্য দিতে গিয়ে অতিথিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন নিজেদের স্মৃতি বর্ণনা করেন। একই সঙ্গে সেই সময় দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনাও উঠে আসে তাদের কথায়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কৃতী শিক্ষার্থী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনন্য অবদান রেখেছেন। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বর্ণনা করে উপাচার্য বলেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের কাজ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য তিনি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।

উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছাত্রজীবনের বর্ণাঢ্য জীবন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ। ডাকসু দেশের নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। তিনি আশা করেন, নির্বাচিত ডাকসু নেতারা জাতির প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেকদের এই একত্র হওয়াকে শুধু মিলনমেলা বলতে নারাজ নৃ-বিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তৈমুর আলম। এটি একটি স্মৃতিচারণ মেলা বলে মনে করেন তিনি। এমন আয়োজনের পিছনের কারিগরদের ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে একত্রিত করার এই প্রয়াস সার্থক হয়েছে।

 

অন্যদিকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিনগুলো এখনো স্মৃতির পাতায় ভিনা চৌধুরীর। তিনি বলেন, এই ধরনের আয়োজন আমাদের একত্রিত করেছে। জীবনের শেষ বেলাও ক্যাম্পাসের প্রিয় দিনগুলো মনে পড়ছে।

মধ্যাহ্ন ভোজের পর বিকালে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের চা-চক্র, আড্ডা, সেলফি এবং সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক অনুষ্ঠিত হয়। স্মৃতিচারণ, আড্ডা, গান ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে তারা সারাটা দিন কাটান এই প্রাণের ক্যাম্পাসে। ফেরার সময় সবার মুখে একটাই কথা ছিল ‘আবার আসিব ফিরে শেকড়ের টানে এ সবুজে ঘেরা প্রিয় ক্যাম্পাসে’।

সর্বশেষ খবর