শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতিবাদী ও মানবিক হওয়ার অঙ্গীকার

বর্ণাঢ্য আয়োজনে পয়লা বৈশাখ উদযাপন

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

প্রতিবাদী ও মানবিক হওয়ার অঙ্গীকার

রাজধানীতে পয়লা বৈশাখে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় -রোহেত রাজীব

মানবিক ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিবাদী মানুষ হওয়ার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নববর্ষ ১৪২৬-কে বরণ করেছে সারা দেশ। নাচে, গানে, কথায়, কবিতায় আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানবিকতা, মানবতা ও বোধের কথাই তুলে ধরেন সংস্কৃতিকর্মীরা। উৎসবের আমেজে সমস্ত অসুন্দর ও অন্ধকারকে ভাসিয়ে দেওয়ার স্রোত ছিল বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ বরণের আয়োজনে। সুরের মাধ্যমে অহিংসতা ও সুন্দরের কথা বর্ণনা করলেন শিল্পীরা। রমনা পার্ক থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমি থেকে টিএসসি, প্রেস ক্লাব থেকে শিশু একাডেমি, চারুকলা থেকে শাহবাগ, শিশু পার্ক হয়ে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ সর্বত্রই ছিল বৈশাখপ্রেমী সব ধর্মবর্ণ ও মতের মানুষের উপচেপড়া ভিড়। বিপ্লবের লাল আর শান্তির শুভ্র রঙের পাশাপাশি বর্ণিল সব রঙে সেজেছিল সর্বস্তরের মানুষ। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে সারা দেশের মতো গোটা রাজধানী ছিল উৎসবমুখর। বৈশাখের প্রথম সূর্যটা উঠতে না উঠতেই উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা : পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। সকাল সাড়ে ৯টায় চারুকলা অনুষদে এ শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, চিত্রশিল্পী নিসার হোসেনসহ চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বাদ্যের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের উচ্ছল নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ-উল্লাসে মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা। ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ প্রতিপাদ্যে এবারের শোভাযাত্রার বাঘ ও বকের অনুষঙ্গকে মূল শিল্পকাঠামো হিসেবে তুলে ধরা হয়। রংবেরঙের মুখোশ, শোলার পাখি, টেপাপুতুল, ঢাকঢোল-বাঁশি, লোকজ ঐতিহ্যের গাজির পটের গাছ ইত্যাদি শিল্পকর্ম নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চারুকলা থেকে বের হয়ে শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা ক্লাব ও শিশু পার্কের সামনে দিয়ে টিএসসি ঘুরে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয় শোভাযাত্রাটি। ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজন : ‘অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত’ প্রতিপাদ্যে এবারের পয়লা বৈশাখ বরণ করেছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। অসিত কুমার দের রাগালাপ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ভোর সোয়া ৬টায় রমনার বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী এ আয়োজন। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার জন্য যখন ক্ষোভে ফুঁসছে দেশ ঠিক সেই সময় ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতি আয়োজনে সব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধের জাগরণের আহ্বান জানান ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন। বরেণ্য এই সংস্কৃতিজনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক মিনিট নীরবতায় সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শপথ নেন অনুষ্ঠানে আগতরা। প্রভাতি এ আয়োজনে ছায়ানটের বড় ও ছোটদের দল সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ১৩টি গান। এ ছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন ১৩ জন শিল্পী। তাদের মধ্যে ছিলেন খায়রুল আনাম শাকিল, লাইসা আহমদ লিসা, চন্দনা মজুমদার, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, সুমন মজুমদার, তানিয়া মান্নান, সঞ্জয় কবিরাজ প্রমুখ।  চ্যানেল আই : হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ করেছে চ্যানেল আই ও সুরের ধারা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম এ আয়োজন। এবারের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, ভারতের হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস, বর্ষবরণ উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইউনিলিভারের সিইও কেদার লেলে, ডিরেক্টর নাফিস আনোয়ার প্রমুখ। এ সময় লোটে শেরিংকে উৎসবের উত্তরীয় পরিয়ে দেন চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ। ডা. লোটে শেরিং ঘণ্টাব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব উপভোগ করেন। তার সম্মানে সংগীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং সারা দেশ থেকে আগত হাজারো শিল্পী। বাংলা ও ভুটানের ভাষায় ‘রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়াল’ গানটি পরিবেশন করেন শিল্পী কোনাল। এরপর লোটে শেরিংকে মঞ্চে নিয়ে আসেন চ্যানেল আইয়ের এমডি ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ ও সুরের ধারার চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে লোটে শেরিং বাংলায় বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে আমার মন থেকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’ তিনি দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার পান্তা ভাত খাইয়েছেন? আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর ঢাকায় এফসিপিএস করেছি। আসলে আমার মন উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত অনুভব করছে কখন ময়মনসিংহ যাব।’ বাংলায় তার মুগ্ধকর কথা শুনে উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। বাংলা একাডেমি : বর্ষবরণ উপলক্ষে বক্তৃতানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে আয়োজিত নববর্ষ-বক্তৃতানুষ্ঠানে মূল বক্তা ছিলেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী।  এ ছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের আড়ংয়ের আয়োজন করা হয়। ১০ দিনের এ আড়ংয়ের উদ্বোধন করেন একাডেমির মহাপরিচালক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বঙ্গাব্দ ১৪২৬ বরণ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। শোভাযাত্রাটি শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, ওয়াইজঘাট, আহসান মঞ্জিল, মুন কমপ্লেক্স, পাটুয়াটুলী, বাটা ক্রসিং হয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে। । স্লোগান ছিল ‘বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শোভাযাত্রা : বাংলা নববর্ষবরণে রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। বৈশাখের দুপুর ১২টার দিকে রমনা পার্কে পুলিশের কন্ট্রোল রুমের সামনে শোভাযাত্রাটির উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ সময় আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া উপস্থিত ছিলেন। কন্ট্রোল রুম থেকে বের হয়ে শাহবাগ প্রদক্ষিণ করে পুনরায় কন্ট্রোল রুমে গিয়ে শেষ হয় শোভাযাত্রা। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য, সোয়াত টিম ছাড়াও মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ফাদার, চলচ্চিত্র জগতের কর্মীরা অংশ নেন শোভাযাত্রায়। এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর. নজরুল একাডেমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, সোনারগাঁও, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, ঢাকা রিজেন্সি, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, অফিসার্স ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা আয়োজনে বর্ষবরণ করে।

প্রেস ক্লাবে বর্ষবরণ : সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১৪২৬ বাংলা নববর্ষকে বরণ করেছে জাতীয় প্রেস ক্লাব। সকালে ক্লাবের সদস্য সন্তানদের কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’- দলীয় সংগীত ও শিশুশিল্পীদের দলীয় নৃত্য দিয়ে শুরু হয় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানিকতা। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত পুতুল নাচ, কুষ্টিয়ার বাউল শিল্পীদের সুরে সুরে নতুন বছরকে বরণ করে নেন ক্লাব সদস্যরা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুরুতে বলেন, নতুন বছর দেশ জাতি ও ক্লাব সদস্যদের জন্য শান্তি ও কল্যাণময় হোক-এই হলো আমাদের প্রার্থনা। এ ছাড়া ক্লাবে খৈ-বাতাসা, মুড়ালি-পায়েসসহ বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।

সর্বশেষ খবর