মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারসাম্যহীন যশোরের রাজনীতি

তরিকুল রাজু টিটো যুগের অবসান

সাইফুল ইসলাম, যশোর

গত কয়েক দশক ধরেই যশোর অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিন বাল্য বন্ধু তরিকুল ইসলাম, আলী রেজা রাজু ও খালেদুর রহমান টিটো। একটানা দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে থেকে রাজনীতিতে তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে সফল হয়েছিলেন তরিকুল ইসলাম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য। মন্ত্রী হয়েছেন বেশ কয়েকবার। কেবল যশোর নয়, পুরো খুলনা বিভাগে বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হতো তার ইশারায়। দলের মহাসচিব হওয়ারও সুযোগ এসেছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিজেই রাজি হননি। মন্ত্রী থাকাকালে যশোর অঞ্চলের উন্নয়নে তার আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। দীর্ঘদিন নানা জটিল রোগে ভুগে গত নভেম্বরে ইন্তেকাল করেন তিনি। তার জানাজায় প্রমাণ করেছিল যশোর অঞ্চলের মানুষের মনে তিনি কীভাবে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। জানাজাস্থল যশোর ঈদগাহ ময়দানসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছিল। তরিকুল ইসলামের আগেই ইন্তেকাল করেন তারই বাল্যবন্ধু আলী রেজা রাজু। একসময় রাজু যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি থাকলেও পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্যও হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগেই ছিলেন। এ দুজনেরই আরেক বাল্যবন্ধু খালেদুর রহমান টিটো এখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আছেন। এরশাদ জামানায় তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। কিন্তু মনোনয়ন না পাওয়ায় চলে যান আওয়ামী লীগে। মনোনয়ন পেয়ে যশোর-৩ (সদর) আসনে তারই বাল্যবন্ধু তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন। এখনো তিনি আওয়ামী লীগেই আছেন, তবে অনেকটাই নিষ্ক্রীয়। গতবার দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, পাননি। সারা দেশের মতো যশোরেও রাজনীতির মাঠে কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপিই দৃশ্যমান হয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের যশোর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার দলের একটি বড় অংশ নিয়ে দল চালান নিজের মতো করে। জেলা কমিটির বেশিরভাগ নেতাই আছেন তার সঙ্গে। অন্যদিকে যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদও নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের অপর একটি অংশকে। জেলা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির নেতা-কর্মীরা দল বদল না করলেও তারা দলের মধ্যেই নিয়মিত পক্ষ বদল করছেন। আজ কেউ কাজী নাবিল আহমেদের জন্য জান দিয়ে দিচ্ছেন, সেই তিনিই আগামীকাল সকালে শাহীন চাকলাদারের হাতে ফুল দিচ্ছেন। আবার এর বিপরীত ঘটনাও ঘটছে। অন্যদিকে যশোর বিএনপির মধ্যে প্রকাশ্যে বড় ধরনের কোনো গ্রুপিং দৃশ্যমান না হলেও দলটির আসন্ন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ভিতরে ভিতরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলটি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত যশোর বিএনপির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। যশোর নগর বিএনপির সভাপতি সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলামও দলের অন্য একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জেলা কমিটি ও জেলার ইউনিটগুলো পুনর্গঠনকে সামনে রেখে এ দুই পক্ষ যে ভালোই সক্রিয় থাকবে, তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে এখনই। দীর্ঘদিন যশোরের রাজনীতিতে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে রেখেছিলেন তরিকুল, রাজু, টিটো- এ তিন বন্ধু। তাদের যুগের অবসানের পর এখন যশোরের রাজনীতির কী অবস্থা? যশোরের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বেনজীন খান। তিনি বলেন, তিন বন্ধুই যশোরের রাজনৈতিক পরিম-লে গত কয়েক দশক ধরেই একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। রাজনীতিতে কিছুটা গুণগত মান তারা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে তরিকুল ইসলামকে যশোরের মানুষ অভিভাবক হিসেবে মনে করতেন। নানা সমস্যা জটিলতায় মানুষ তাদের কাছে যেতেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতেন। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের এখন আর সেই আশ্রয়-প্রশ্রয়ের জায়গাটা নেই। এই জায়গায় ঘাটতি হয়ে গেছে। যশোরের মানুষ এখন অসহায়। বেনজীন খান বলেন, তরিকুল ইসলামের উত্তর যশোর বিএনপিতে এখন ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্যই বেশি। বৃহৎ রাজনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে ব্যক্তিগত স্বার্থে দল-উপদল সৃষ্টির প্রবণতা এখন প্রবল। এর বিপরীতে দরকার ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, উদার ও বিরাট হৃদয়ের নেতৃত্ব, সেটা এখন নেই। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ বহুদিন ধরেই বিভক্ত। নেতারা প্রশাসনকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত। ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টায় দল-উপদলের মধ্যে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটছে। রাজনীতির চেয়ে স্বার্থ সিদ্ধিটায় এখন বড় হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। এসবের বিপরীতে যাদের সবচেয়ে বেশি কথা বলার ছিল, সেই বিএনপি দলটাই এখন ব্যর্থ দলে পরিণত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর