মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

সরকার ধান কিনলেও লাভ হচ্ছে না কৃষকের

দেরিতে ধান কেনায় লোকসানে কৃষক, সিন্ডিকেটে লাভবান চালকল মালিক ও আড়তদার

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সরকার ধান কিনলেও লাভ হচ্ছে না কৃষকের

সরকার দেরিতে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করায় লোকসান গুনছেন কৃষক। মৌসুমের শুরুতেই সিন্ডিকেট করে ধানের দাম কমিয়ে মজুদ বাড়িয়েছেন চালকল মালিক ও আড়তদার। ফলে সরকার দফায় দফায় ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিলেও লোকসান পোষাচ্ছে না কৃষকের। কৃষকের চাষের খরচ না উঠলেও ভোক্তাকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে চাল। ধান-চালে নয়ছয় করে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল ধান। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় ইতিমধ্যে চার লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রয়োজনে পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা আরও সক্রিয় থাকব। যুগোপযোগী কৃষিপ্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে।’ ১১ জুন খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, এবার বোরোর ফলন ‘অনেক উদ্বৃত্ত’ হয়ে  গেছে। দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে ২৬ টাকা কেজি দরে আরও আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে একই দামে দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলতি বোরো মৌসুমে মোট চার লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রয়োজনে আরও দু-এক লাখ টন ধান কেনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।  খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৮ মার্চ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধান কমিটির (এফপিএমসি) বৈঠকে চলতি বোরো মৌসুমে মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ এপ্রিল শুরু হওয়া সংগ্রহ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এর মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান, ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ১ লাখ ৫০ হাজার টন আতপ চাল থাকবে। আর প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহমূল্য ২৬ টাকা, প্রতি কেজি সেদ্ধ চালের দাম ৩৬ টাকা এবং প্রতি কেজি আতপ চালের দাম ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয় শুরু হতে দেরির কারণে ফড়িয়ারা সেই সুযোগ নেয়। তারা ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করলে ধান নিয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন কৃষকরা। এ পরিস্থিতিতে কৃষক বাঁচাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মন্ত্রণালয়কে বেশি ধান কেনার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পাশাপাশি চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়ানো হয়। কিন্তু কৃষকের ধান ততক্ষণে পৌঁছে যায় আড়তদার ও চালকল মালিকের গুদামে।

সাম্প্রতিক সময়ে বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করায় বাজারে ধানের মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার দাবি উঠেছে।

বাংলাদেশে ধানচাষিদের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। ১৯৯৬ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ৭৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, মাঝারি কৃষক ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং বড় কৃষক ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা ধারদেনা করে ফসল ফলান। ফলে ধান কাটার মৌসুমের শুরুতেই তারা বহু কষ্টে ফলানো ফসল বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান। সরকার দেরিতে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা বাধ্য হন চালকল মালিক ও আড়তদারদের কাছে ফসল বিক্রি করতে। চালকল মালিকরা এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যতটা সম্ভব কম দামে ধান কিনেছেন। কম দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে চালে পরিণত করে মজুদ করেন তারা। একই ধারাবাহিকতায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সময়মতো চাল বিক্রি করে লাভবান হন চালকল মালিকরা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ধান কাটার পরই স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকেন। এদিকে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান না কেনায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয় না। তাই রপ্তানি করে কিংবা দাম বাড়িয়ে সংগ্রহ করলে কৃষকের ক্ষতি কমে না। কারণ ধান তখন কৃষকের হাত থেকে চলে যায় চালকল মালিক ও আড়তদারদের হাতে। এ জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ক্ষমতায়িত করতে হলে সমবায়ের ভিত্তিতে কিংবা ইউনিয়ন স্টোরেজ সুবিধা প্রদান করে সরাসরি ধান সংগ্রহ করা যেতে পারে।

সিন্ডিকেটে জিম্মি কৃষক : নওগাঁ প্রতিনিধি বাবুল আখতার রানা জানান, সিন্ডিকেটের কারণে নওগাঁয় ধানের ব্যাপক দরপতনে দিশাহারা কৃষক। এ জন্য কৃষক ও ক্ষুদ্র চালকল মালিকরা অটোমেটিক চালকল মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন।  নওগাঁর সবচেয়ে বড় ধানের হাট মাতাজীহাটে গিয়ে বেশ কয়েকজন কৃষক ও চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা। আর এক মণ ধান ফলাতে খরচ পড়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। অথচ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকা দরে। কৃষক ধান নিয়ে এক হাট থেকে আরেক হাটে ঘুরছেন তবু উঠছে না খরচের টাকা।  নওগাঁর ফারিহা রাইস মিলের মালিক শেখ ফরিদ এবং বিসমিল্লাহ মিলের মালিক শাহাদত হোসেন বলেন, ধানের দাম কম হওয়ার মূল কারণ ক্ষুদ্র চালকল, অর্থাৎ হাসকিং মিল ও অটোমেটিক রাইস মিলের বরাদ্দের সমন্বয়হীনতা। হাসকিং মিলারদের বরাদ্দ কম হওয়ায় তারা বাজারে ধান কিনছেন না। ফলে বাজারে ক্রেতা কম হওয়ায় ধানের দাম কম। সঠিকভাবে হাসকিং মিলারদের বরাদ্দ যদি দেওয়া হতো তাহলে গুটিকয় অটোমেটিক মিলার এ সিন্ডিকেট তৈরি করতে পারতেন না।

নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ধানের দাম পেতে হলে ক্রেতা বৃদ্ধি করতে হবে। হাসকিং মিলারদের বরাদ্দ খুব কম হওয়ায় তারা ধান কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে একসময় ধান-চালের বাজার অটোমিলারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

সরকারের ধান কেনার খবর জানেন না কৃষক : কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা জানান, মাঠ থেকে সরকারের ১ হাজার ৪০ টাকা মণ দরে ধান ক্রয়ের খবর জানেন না অধিকাংশ কৃষক। বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক কৃষকদের দাবি এখন পর্যন্ত সরাসরি একমুঠো ধানও বিক্রি করতে পারেননি তারা। যাদের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে শুধু তারাই ঘুষ দিয়ে ধান বিক্রি করতে পারছেন। এ ছাড়া একটি এলাকায় ১০০ কৃষক ধান বিক্রির উপযোগী হলেও ধান কেনা হচ্ছে ১০-১২ জন কৃষকের কাছ থেকে।

জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, কুমিল্লায় এবার ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৬০ হাজার ২৫৯ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় লাখ কৃষক। মাঠে ফসলের বাম্পার ফলন হলেও বর্তমান বাজারে ধান দাম কম হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষক।

জেলার লাকসাম উপজেলার মনপাল গ্রামের আলী আকবর ও মিজিয়াপাড়া গ্রামের আবুল খায়ের জানান, সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ৪০ টাকা দামে তাদের গ্রামের কেউ ধান বিক্রি করেছেন কি না তারা শোনেননি। তারা ৫৮০ টাকা দরে ধান বিক্রি করেছেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়সার আলী বলেন, ‘জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের তালিকা অনুসারে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করছি। এবার জেলার ১৭ উপজেলা থেকে চার হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করব।’ প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকেই ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর