হুক্কায় বুঁদ হয়ে আছে লেবানন। শহর থেকে গ্রাম, শহরতলি, অলি-গলি সর্বত্র হুক্কার ছড়াছড়ি। শহরের প্রায় প্রতিটি মার্কেট, শপিং মলে হুক্কা এবং তামাক পণ্যের বাহারি দোকান। বৈরুতজুড়ে হুক্কা সেবনের এত প্রলুব্ধকর আয়োজন দেখলে যে কারও হুক্কা নিয়ে বসে যেতে ইচ্ছা করবে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল হুক্কা বার। সেই হুক্কা বারে দুপুরের পর থেকেই ভিড় জমতে থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত পরিবারের ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে হুক্কায় মগ্ন থাকে লেবানিজরা। হুক্কার বারগুলোর অধিকাংশই গড়ে উঠেছে অনেকটা ড্রয়িংরুমের আদলে। যেন একসঙ্গে অনেক ড্রয়িং রুম জোড়া লাগানো। সোফায় হেলান দিয়ে হুক্কা টানতে টানতে গভীর রাত পর্যন্ত পার করে দেয় লেবানিজরা। সঙ্গে থাকে হালকা কোনো পানীয়। বাদাম, ফলফলাদি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের কেটে যায় হুক্কা টানতে টানতে। যেন এই ধোঁয়া ধুসরিত সামগ্রী ছাড়া জীবনের আর কোনো কিছু তাড়া নেই। লেবাননের বাঙালি অধ্যুষিত সাবরা বাজারে রবিবার হাটবারে কথা হয় বাংলাদেশি রকিবুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোটবেলা আমরা দেখেছি, আমাদের বাপ-দাদারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই হুক্কা টানতেন। তাদের তামাক সাজিয়ে দেওয়ার জন্য আলাদা লোক থাকত। এখানে এসে দেখি সেই হুক্কা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে আছে। এখানে এর বাণিজ্যিক কদর অনেক বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৬০ লাখ মানুষের এই দেশে হুক্কা তাদের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা। বড় সাইজের স্টিলের হুক্কার নিচের অংশে থাকে পানি। আর উপরে ছিলিমের ভিতর থাকে ধূমপানের নানা উপকরণ। ছিলিমটি ছিদ্রযুক্ত অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে মোড়ানো থাকে। ছিলিমের ওপর থাকে চারটি করে জ্বলন্ত কয়লা। বারের ওয়েটার ১৫/২০ মিনিট পর পর কয়লার আগুন বদল করে দিয়ে যায়। ৩/৪ ডলারে প্রতিবার হুক্কা ব্যবহার করা যায়। প্রতিটি পরিবারের একাধিক হুক্কা রয়েছে। তারা বাইরে আড্ডায় কিংবা পিকনিক, সামাজিক সমাবেশে গেলে হুক্কা সঙ্গে নিয়ে যায়। মানভেদে প্রতিটি হুক্কা কিনতে পাওয়া যায় ১০ থেকে ৫০/৬০ ডলারে। বৈরুতে কর্মরত বাংলাদেশি সাংবাদিক বাবু সাহা বললেন, হুক্কা সেবন লেবানিজদের সংস্কৃতির অংশ। বিভিন্ন ফ্লেবারের হুক্কা পাওয়া যায়। তার মধ্যে টোব্যাকো, আপেল, লেমন, পুদিনা ফ্লেবার অন্যতম। যার যে ফ্লেবার পছন্দ অর্ডার দিলেই অল্প সময়ের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশে এখন কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে হুক্কা নামে জনপ্রিয় লাখো মানুষের এ ধূমপানের বস্তুটি। ৩০-৪০ বছর আগেও গ্রামগঞ্জে ধূমপায়ীরা হুক্কার নেশায় অভ্যস্ত ছিল। উঠতি বয়সের যুবক থেকে শুরু করে বয়স্ক বিত্তবান ধনী ও দরিদ্র অনেকের বাড়িতেই হুক্কার প্রচলন ছিল। গ্রামের বৈঠকখানাগুলোতে পালাক্রমে হুক্কা টানত বিভিন্ন বয়সের পুরুষরা। বিত্তবানদের বাড়িতে ছিল দীর্ঘ নলের হুক্কা। চেয়ারে গা এলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে গৃহকর্তা নলের পাইপ মুখে দিয়ে যখন জমিদারি ভঙ্গিমায় টান দিত তখন এ দৃশ্য অপলক চোখে চেয়ে থাকত বেঠকখানায় আগতরা। তামাক পাতা টুকরো টুকরো করে কেটে এতে চিটা গুড় মিশিয়ে তৈরি হতো হুক্কার প্রধান উপাদান। এতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নিঃসরিত ধোঁয়াগুলো হুক্কার তলানির পানিতে ডুবিয়ে ‘কুড়ুত কুড়ুত’ শব্দ করে বের হয়ে আসত। এক ধরনের ঘ্রাণ বের হতো তা থেকে। হুক্কার নিচের অংশের পানির কুড়ুত কুড়ুত শব্দে দূর থেকেও বোঝা যেত আশপাশে কেউ হুক্কা টানছে। বাংলাদেশে এখন আর সেই পরিচিত দৃশ্য ও শব্দটি নেই। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখনো হুক্কা দেখেনি। এর স্থান দখল করে নিয়েছে বিড়ি, সিগারেটসহ অন্যান্য সামগ্রী। কিন্তু লেবাননে সিগারেটের ব্যাপকতা থাকলেও হুক্কা তাদের জীবনেরই অংশ।