শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ব্যাংকক সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম খরচে উন্নত চিকিৎসা মালয়েশিয়ায়

মাহমুদ আজহার, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে

ব্যাংকক সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম খরচে উন্নত চিকিৎসা মালয়েশিয়ায়

কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে মালয়েশিয়ার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো। সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক উন্নতমানের যন্ত্রপাতির সাহায্যে     এ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে তার পরিবারের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাও রয়েছে। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি রোগীর পরিবারের সঙ্গে ‘পারিবারিক বন্ধন’ সৃষ্টিও করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শীর্ষ পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে মালয়েশিয়া, যা গ্লোবাল মার্কেট রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, উন্নত চিকিৎসা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে খরচ বিবেচনায় অষ্টম স্থানে। মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের (এমএইচটিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন প্রায় ১২ লাখ বিদেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছেন ৫০ হাজার। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গেলে ইমিগ্রেশন বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়। কিন্তু চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়ায় গেলে কোনো দুর্ভোগ তো নয়ই, বিমান থেকে নামার পর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যাওয়া হয় রোগী ও তার স্বজনদের। এমনকি বিমানবন্দরের ভিতরই ‘মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার লাউঞ্জ’ (এমএইচটিসি) এমএইচটিসি লাউঞ্জ নামে রোগীদের সেবায় একটি ডেস্ক রাখা হয়েছে। ওই সংগঠনের কর্মীরা রোগীদের নিয়ে এসে নিজ নিজ পছন্দের হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন। গাড়ির ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। চিকিৎসাসেবা শেষ হয়ে নিরাপদে দেশে ফেরা পর্যন্ত বিমানবন্দর পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া হয় রোগী ও তার স্বজনদের। সম্প্রতি এমএইচটিসির আমন্ত্রণে মালয়েশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দেশটির স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি দেখতে বাংলাদেশ থেকে একদল সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হয়। মালয়েশিয়ার প্রধান বিমানবন্দরে নেমেই গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এমএইচটিসি কর্মীদের। ইমিগ্রেশনে কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই প্রতিনিধি দলকে নিয়ে যাওয়া হয় এমএইচটিসি লাউঞ্জে। সেখানকার কর্মীরা জানান, রোগীদের ক্ষেত্রেও তারা একইভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। তিন দিনের সফরে দেখানো হয় কুয়ালালামপুরের থমসন হসপিটাল, টিএমসি ফারটিলিটি অ্যান্ড ওমেন্স স্প্যাসালিস্ট সেন্টার, গ্লিনেগেলস হসপিটাল, সান ওয়ে মেডিকেল সেন্টার, কেপিজে আমপাং পুত্রেই ও কেপিজে দামানসারাসহ কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতালের চিত্র। হাসপাতালগুলো মূলত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা যায়, আধুনিক ও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হাসপাতালগুলোতে বেশ গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ বিশ্ব বিখ্যাত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এসব হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। দেখা যায় সেখানকার চিকিৎসক, রোগী, নার্সসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের পরিবেশ। হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নোংরা পরিবেশ তো নেই-ই, কিছু সময় পর পর দেখা যায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। মতবিনিময়কালে মালয়েশিয়া হেলথ ট্রাভেল কাউন্সিলের সিইও শেরিন আজলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। অনেকেই সেকেন্ড হোম হিসেবে দেশটিকে ব্যবহার করছেন। এখানকার রান্না-খাওয়া সবকিছুই হালাল। কাজেই মুসলিম দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া নিজের দেশের মতোই মনে করতে পারেন বাংলাদেশ থেকে আগত রোগীরা। বাংলাদেশে আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে সহজেই রোগীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও ভিসা করাতে পারবেন। আমরা বিমানবন্দরে রোগীদের জন্য আলাদা লাউঞ্জ রেখেছি। চিকিৎসার জন্য আসা পর্যটকরা বিমানবন্দরে পৌঁছালেই সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। হাসপাতাল পৌঁছানো থেকে শুরু করে বাকি কাজটুকু এমএইচটিসি করে থাকে।’ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রোগীদের আস্থায় নিয়ে আসার জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। কঠিন চিকিৎসাও সহজভাবে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিটি রোগীকে যতেœর সঙ্গে দেখা হয়। রোগী দেখার সময় কোনো তাড়াহুড়া করা হয় না। প্রতিটি রোগীকে অন্ততপক্ষে ২০-২৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া দিকনির্দেশনা মেনে চলতে হয়। একজন চিকিৎসকের জন্য সর্বোচ্চ দুটি চেম্বার থাকতে পারে। রোগীর কাছ থেকে কত টাকা ফি নেওয়া হবে তাও সরকার-নির্ধারিত। আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে একজন চিকিৎসককে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আন্তর্জাতিক মানের বেশ কিছু গবেষণাপত্র থাকতে হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

গ্লিনেগেলস হাসপাতালের আন্তর্জাতিক বিপণন বিভাগের ম্যানেজার ফজল আজওয়ানদি বিন আবু বকর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে হাসপাতালগুলোর রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সরকার থেকে চিকিৎসার একটি সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বেশি আদায় করলে রোগী স্বাস্থ্য বিভাগে অভিযোগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ান সরকার খুব কঠোর।’

কেপিজে আমপাং পুত্রেই বিশেষায়িত হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. ইকা ফায়জুরা জানান, ‘গত দুই বছরে হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সব যন্ত্রপাতি বদলানো হয়েছে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগীদের আধুনিক মানের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগে আমাদের রোগীদের এক থেকে তিন মাস পর পর ফলোআপে আসতে হতো। এখন আমরা ছয় মাস পর ফলোআপ করি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এটি সম্ভব হচ্ছে।’

পেশেন্ট বিয়ন্ড বর্ডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, হার্টের বাইপাস সার্জারিতে সিঙ্গাপুরে যেখানে ৫৪ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়, সেখানে মালয়েশিয়ায় খরচ পড়ে মাত্র ২০ হাজার মার্কিন ডলার। থাইল্যান্ডের তুলনায়ও যা ১৩ হাজার মার্কিন ডলার কম। বাল্ব প্রতিস্থাপনে সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কম খরচ পড়ে মালয়েশিয়ায়। সিঙ্গাপুরে যেখানে এর জন্য খরচ করতে হয় ৪৬ হাজার মার্কিন ডলার, সেখানে মালয়েশিয়ায় তা ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। আর থাইল্যান্ডে এই খরচ ১৯ হাজার মার্কিন ডলার। আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি নিতে আগ্রহীদেরও কম খরচ পড়বে মালয়েশিয়ায়। ওষুধ খরচ ছাড়া আইভিএফের একটি সাইকেলে সেখানে খরচ পড়বে চার হাজার ২০০ ডলার, যা সিঙ্গাপুরের অর্ধেক।

স্বাস্থ্যসেবায় মালয়েশিয়ার অগ্রগতির স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্থাস্থ্য সংস্থাও। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে গ্লোবাল রিটায়ারমেন্ট ইনডেক্সের ‘বেস্ট কান্ট্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ফর হেলথকেয়ার’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে দেশটি। ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ট্রাভেল জার্নাল ২০১৫ সাল থেকে টানা তিন বছর মালয়েশিয়াকে দিয়েছে মেডিকেল ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবায় অবদানের জন্য গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি ও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মালয়েশিয়া। এ ছাড়া থাকার জন্য হোটেল ব্যবস্থাপনা এবং এমনকি শপিং মল, হালাল রান্না ও প্রার্থনার সুবিধাও রয়েছে। ২০১১ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত মুসলিম পর্যটন শীর্ষস্থানীয় ছিল দেশটি। মুসলিম ভ্রমণে মাস্টারকার্ড-ক্রিসেন্ট রেটিং গ্লোবাল।

জানা যায়, মালয়েশিয়ার সরকারি হাসপাতালগুলো শুধু সে দেশের নাগরিকদেরই চিকিৎসা দিয়ে থাকে। অন্তত ৪০ শতাংশ মালয়েশীয় নাগরিক বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য আগত পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকারিভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে। চিকিৎসায় এশিয়ার শীর্ষস্থানে নিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ বা পিপিপির আওতায় মালয়েশিয়া হেলথকেয়ারের অধীনে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিল, যারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবার মান তদারক করছে এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে দেশের স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিগন্ত।

জানা যায়, ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার বিশ্বব্যাপী ১.২ মিলিয়নের (১২ লাখ) বেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে সেবা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই বাংলাদেশি ছিল। চলতি বছর মে পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার কারণ এখানকার দক্ষ চিকিৎসক ও উন্নত প্রযুক্তি। শেরেন আজলি বলেন, ‘হৃদরোগ ও ফার্টিলিটি চিকিৎসায় এশিয়ার সেরা হাব হতে চায় মালয়েশিয়া। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি এবং ২০২০ সালকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা ভ্রমণের বছর হিসেবে পালন করব।’

সব রোগীকেই সর্বোচ্চ সেবা দিতে বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে কেপিজে আমপাং পুত্রেই হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এন্ড্রু উইলিয়াম বার বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রোগীদের ব্যাপারে আমরা আরও অধিক সচেতন। এরই মধ্যে বাংলাদেশে আমরা কেপিজে-শেখ ফজিলাতুন নেছা হাসপাতাল করেছি। আশা করি, মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার সম্পর্ক আরও নিবিড় হবে।’

সর্বশেষ খবর