রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

থমকে আছে অর্পিত সম্পত্তির মামলাগুলো

৬১ জেলায় বিচারাধীন ৬৮ হাজার, ৪৩ হাজার মামলাই ৫ বছরের বেশি পুরনো

আরাফাত মুন্না

ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার রামানন্দপুর গ্রামের প্রয়াত অমরেন্দ্র লাল দাস সাড়ে চার একর সম্পত্তির মালিক ছিলেন ওয়ারিশ সূত্রে ও ক্রয় সূত্রে। বংশানুক্রমে তিনি ভোগদখলও করে আসছিলেন। কিন্তু অজানা কারণে ওই সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত হয় অর্পিত সম্পত্তির ‘ক’ তফসিলে। ওই সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য অমরেন্দ্র ফেনীর আদালতে মামলা করেছিলেন ২০০৯ সালে। ফেনীর প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি ৯ বছরেও। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কার্যকর ওই আদালতে মামলা চালাচ্ছেন অমরেন্দ্রর উত্তরসূরিরা। শুধু অরেন্দ্র লাল দাসের এই মামলাটি নয়, দেশের আদালতগুলোতে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ৬৮ হাজারেরও বেশি মামলার বিচার এক প্রকার থমকেই আছে। এসব মামলার মধ্যে ৪৩ হাজার মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলন্ত। জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-১৯৬৫’ অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ‘শত্রু সম্পত্তির’ নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ রাখা হয়। অর্পিত সম্পত্তি মূল মালিক বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সেই বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হয় ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিলে। দুটি তফসিলের সম্পত্তি অবমুক্ত করতে লাখ লাখ মামলা হয় তখন। পরে সরকার ‘খ’ তফসিলের সম্পত্তি অবমুক্ত করে দেয়। জনসাধারণের দখলে থাকা এসব সম্পত্তি এমনিতেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এখন ‘ক’ তফসিলের সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে। এদিকে সম্পত্তি ফিরে পেতে মামলা করে নতুন বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকেই। আইনি প্রক্রিয়ায় ওই সব সম্পত্তি অবমুক্ত করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ২০০১ সালে প্রণীত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের ১০ ধারায় ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান আছে। গত বছর ১ এপ্রিল হাই কোর্টের এক রায়েও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ সবই উপেক্ষিত থাকছে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান (চলতি জুন পর্যন্ত) অনুযায়ী, পার্বত্য তিন জেলা ব্যতীত দেশের ৬১ জেলায় অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ৬৮ হাজার ৬৬৪টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি মামলা খুলনায়। এখানে অর্পিত সম্পত্তির পাঁচ হাজার ৪৬৪টি মামলা বিচারাধীন। যার মধ্যে দুই হাজার ৯৬২টি পাঁচ বছরের বেশি পুরনো। এ ছাড়া ঢাকায় থাকা অর্পিত সম্পত্তির চার হাজার ২৩৬টি মামলা মধ্যে ৫১২টি, বরিশালে চার হাজার ৫৯১টির মধ্যে ২ হাজার ১২৯টি, সাতক্ষীরায় চার হাজার ২৭১টির মধ্যে তিন হাজার ৬০৫টি মামলা পাঁচ বছরের বেশি পুরনো। আর বাগেরহাটে মোট বিচারাধীন মামলার তিন হাজার ৬৪৫টি মামলাই বিচারাধীন পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। অন্যদিকে অর্পিত সম্পত্তির সব চেয়ে কম মামলা মাগুরায়। এখানে মাত্র ৩৪টি মামলা বিচারাধীন। অবশ্য এর মধ্যে ৩১টি মামলাই পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয় ২০০৮ সালে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ সোয়া দুই লাখ একরের মতো। এগুলো প্রত্যর্পণের জন্য বিভিন্ন আদালতে আবেদন পড়েছে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার। ২০১২ ও ২০১৩ সালে ওই সব আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার মামলা। এক লাখেরও বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। সাত বছর ধরে এত মামলা ঝুলে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে যেসব মামলা বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন, তা নিষ্পত্তি হতে ৩০ বছর লাগবে। কারণ গত সাত বছরে মাত্র ১২ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাই কোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হচ্ছে। আবার যারা মামলার মাধ্যমে সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার ডিক্রি বা রায় পেয়েছে, তাদেরও সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর