শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চা বাগানে সৌন্দর্যের আড়ালে মাদক

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

চা বাগানে সৌন্দর্যের আড়ালে মাদক

চা বাগান অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৪৮টি বাগানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। এই চা শ্রমিকদের জন্য ব্রিটিশ আমলেই বাগানে মদের প্রচলন হয়। শ্রমিকরা সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সন্ধ্যা হলেই মদের নেশায় ডুবে থাকতেন। কিন্তু সেই বাংলা মদ এখন আর শুধু চা বাগানে সীমাবদ্ধ নেই। বাগানের গি  পেরিয়ে শহর ও গ্রামে বিস্তার লাভ করেছে। বাংলা মদের নেশায় মত্ত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ। তিন দিকে চা বাগান আর একদিকে হাওরবেষ্টিত এ উপজেলায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় বাংলা মদ। শ্রমিকদের ক্লান্তি, অবসাদ আর কষ্ট ভুলিয়ে রাখতে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের জন্য বাগানে খুলে দেয় বাংলা মদের দোকান, যা ‘পাট্টা’ নামে পরিচিত। সারা দিন বাগানে কাজ করে সন্ধ্যা নামলে এসব পাট্টায় গিয়ে শ্রমিকরা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। আর সকালে নেশার ঘোর কাটলে আবার যোগ দেন বাগানের কাজে। ব্রিটিশ আমল থেকে বাগানের শ্রমিকদের এটাই অভ্যাস। শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ, ব্রিটিশরা এই পাট্টার মাধ্যমে চা বাগানগুলোয় দেশীয় মদ ছড়িয়ে দেয়। শ্রমিকরা যাতে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে না পারেন, তারা যেন লেখাপড়া শিখতে না পারেন এমনকি উপার্জিত অর্থ যেন সঞ্চয় করতে না পারেন এজন্যই কৌশলে বাগানে মদের প্রচলন করা হয়। পাট্টাগুলো ঘিরে বর্তমানে প্রতিটি চা বাগানের ঘরে ঘরেই মদের ব্যবসা চলছে।

জানা গেছে, এখন চা শ্রমিকদের তুলনায় বাইরের মানুষ বাগানে গিয়ে বেশি পরিমাণে মদ পান করছে। অনেক পাট্টা থেকে প্রতিদিনই গ্যালন গ্যালন মদ বাগানের বাইরে বিক্রি হচ্ছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসূত্রে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার ১৪টি চা বাগানে মদের দোকান রয়েছে। পাট্টা মালিকরা বাগানের চা শ্রমিকদের নামে চাহিদাপত্র দেখিয়ে ডিপো থেকে মদ তুলছেন। তবে এসব দোকানে প্রতি মাসে কার কার নামে কী পরিমাণ মদ ইস্যু হচ্ছে এ তথ্য দিতে অপারগতা জানায় জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস। তবে শ্রীমঙ্গল মাদকদ্রব্য পণ্যাগারের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত মাসে ডিপো থেকে জেলার ৪৫টি মদের পাট্টায় সেভেনটি বাংলা মদ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ লিটার ও থার্টি বাংলা মদ ১ হাজার ১২০ লিটার উত্তোলন করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, চা বাগানের এসব বৈধ মদের পাট্টা থেকে মদ কিনে নেন বাংলা মদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী। সেই মদ তারা নিয়ে যান প্লাস্টিকের ছোটবড় ড্রামে করে রিকশা বা সিএনজিচালিত আটোরিকশায়। কখনো পুলিশ বা র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন, কখনো প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে যান গন্তব্যে। শহরের আরামবাগ, সবুজবাগ ও সুইপারপট্টিতে বাংলা মদ বিক্রি হয়। এ ছাড়া উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের ভীমশি, গন্ধর্বপুর, মির্জাপুর ইউনিয়নের শমশেরগঞ্জ এলাকায় বাংলা মদ বিক্রি হয়। বাগানের পাট্টা থেকে জেলা সদর পর্যন্ত মদ সরবরাহ হয়। অথচ আইনে আছে, লাইসেন্স, পারমিট বা পাস ছাড়া কোনো অ্যালকোহল কেনা অথবা বেচা, বহন, সরবরাহ, পরিবহন, এমনকি সেবনও করা যাবে না। শ্রীমঙ্গল মাদকদ্রব্য পণ্যাগারের পরিদর্শক মো. আবু জাফর বলেন, ‘সব অনিয়মই তো এখন নিয়ম। তা ছাড়া মানুষ বাংলা মদ না খেলে আর কী খাবে। এই বাংলা মদও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশায় ঝুঁকে পড়বে।’ গত এক বছরে চা বাগান থেকে চোরাই পথে নিয়ে যাওয়ার সময় ১০ হাজার ৪৬ লিটার মদ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া সাড়ে ১৯ কেজি গাঁজা, ৭ হাজার ৮৮৯ পিস ইয়াবা ও ২১৬ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। এই সময়ে ১৮৯ বোতল হুইস্কি, ১১ বোতল বিয়ার ও ১৯০ বোতল বিদেশি মদও উদ্ধার করা হয়। জাগছড়া চা বাগানের শ্রমিক গণেশ গোয়ালা বলেন, ‘আগে সরকারের লাইসেন্স করা পাট্টাতেই শুধু মদ বিক্রি হতো। যাদের নামে পারমিট ছিল শুধু তারাই মদ খেতেন। কিন্তু এখন আর বাগানের পাট্টায় নিয়ম মেনে মদ বিক্রি হয় না। পাট্টা থেকে কিনে নিয়ে ঘরে ঘরে মদ বিক্রি হয়।’ প্রায় প্রতিটি চা বাগানে শ্রমিকদের ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে অবৈধ চোলাই মদের দোকান। শ্রমিকরা ইউরিয়া সার, সুয়াগা, গুড়মিশ্রিত জল, সিডাকসিন ট্যাবলেট দিয়ে এ মদ তৈরি করেন। আবার কোনো কোনো চা বাগানে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, গাঁজা। চা শ্রমিকদের অভিযোগ, বাগানের এসব বৈধ ও অবৈধ মদের দোকান থেকে কতিপয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা বখরা নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কমলগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রামভজন কৈরী বলেন, ‘একজন চা শ্রমিকের বাগানে কাজ না থাকলে মালিকপক্ষ তাকে বাগানে থাকতে দেয় না। অথচ শুধু মদ বিক্রির জন্য মালিকরা জমি দিয়ে ঘর বানিয়ে দেয়।’ মৌলভীবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল মজিদ বলেন, ‘পাট্টা থেকে বাগানের বাইরে মদ বিক্রি হয় এমন তথ্য আমার জানা নেই। পাট্টার মালিকদের সাব ডিলার দিয়ে বাগানে মদ বিক্রিরও নিয়ম নেই।’

সর্বশেষ খবর