শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

নসিমন করিমনে বিপন্ন মহাসড়ক

২২ মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের রাজত্ব

শিমুল মাহমুদ

নসিমন করিমনে বিপন্ন মহাসড়ক

দেশের লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ার পর এ পথে যানবাহনের গতি বেড়েছে। কমেছে যানজট। প্রশস্ত মহাসড়কে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজি, ভটভটি, রিকশাভ্যান। এমনকি ৮০ কিলোমিটার গতির দূরপাল্লার বাসের সামনে উল্টো দিক থেকে হুট করে চলে আসছে এসব থ্রি-হুইলার। ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এ মহাসড়কসহ দেশের সব কটি মহাসড়কে যান চলাচলে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মহাসড়কগুলোয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ বিপজ্জনক নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ নানা নামের থ্রি-হুইলার। এসব বিপজ্জনক যানবাহনের কারণে বিপন্ন মহাসড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বড় অংশ ঘটছে ২২টি মহাসড়কে, বিপজ্জনক থ্রি-হুইলারের সঙ্গে সংঘর্ষে। এসব প্রেক্ষাপটে চার বছর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সারা দেশে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, টেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলা নিষিদ্ধ করেছিল। তখন বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে যেসব সড়ক-মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে, সেসব মহাসড়কের পাশে ধীরগতির যানবাহন

চলায় বাইলেন নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সেই ঘোষণা ও প্রজ্ঞাপনের চার বছর পরও মহাসড়কে অরাজকতা বন্ধ হয়নি। উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ধীরগতির থ্রি-হুইলারের জন্য বিকল্প লেন তৈরির। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের পর বারবার চেষ্টা করেও দেশের ২২ মহাসড়কে নসিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটিসহ অনিয়ন্ত্রিত যান চলা বন্ধ করা যায়নি। ফলে দেশজুড়ে থামছে না সড়ক দুর্ঘটনার তা-ব। এসব অবৈধ যানবাহনের কারণে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সড়ক-মহাসড়ক। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। অটোরিকশা, ইজিবাইক, লেগুনা, নসিমন, টেম্পো, ভটভটি, আলমসাধু, মাহেন্দ্রসহ অবৈধ যানবাহনের কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশের সর্বত্রই অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনগুলোর ‘বিপজ্জনক’ চলাচলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছেন যাত্রীরা। ২০১৯ সালে দেশে ৪ হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২২৭ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯৫৩ জন। এর অর্ধেকই পথচারী। এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী মহাসড়কে চলা বাস ও ট্রাক। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মহাসড়কে চলা নিষিদ্ধ যানবাহনকে প্রধান সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে করা নিরাপদ সড়ক চাইয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৮ জন বেশি নিহত হয়েছেন।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন ৪ জানুয়ারি দুর্ঘটনা প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেন, মহাসড়কে কম গতির যানবাহনগুলোর কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। বলেন, গত বছরে এ মহাসড়কে মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। এ মহাসড়কটি চার লেন হলেও সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ কম গতির নানা যানবাহন চলে। এ ছাড়া একটু পরপর দেখা যায় রিকশাস্ট্যান্ডের মতো জায়গায় মানুষের জমায়েত। তিনি বলেন, চার লেন হওয়ার পর রাস্তায় যানবাহনের গতি বেড়েছে, একই সঙ্গে রাস্তায় নসিমন, করিমনসহ কম গতির যানবাহন চলতে দেওয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেড়ে গেছে।

এদিকে মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধ ও যানবাহনের নিরাপত্তায় সরকার ১৪ বছর আগে ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের মতো একটি আলাদা ইউনিট নিয়োজিত করলেও তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে সড়কে নিষ্ক্রিয়তা ও কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তানভির হায়দার চৌধুরী বলেন, কার্যপরিধি ও জনবল কম থাকায় মহাসড়কের সব অংশে নজরদারি নিশ্চিত করতে পারে না হাইওয়ে পুলিশ। তিনি বলেন, হাইওয়ে পুলিশের ৭৬টি আউটপোস্ট আছে, কিন্তু সেগুলো সব জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক কাভার করে না। এদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ১০ জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, নাটোর, রাজশাহীতে এমনকি অন্য জেলাগুলোতেও প্রতিনিয়ত অবৈধ থ্রি-হুইলারের সঙ্গে ভারী যানবাহনের সংঘর্ষ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। অল্পবয়স্ক, আনাড়ি চালকদের নিয়ন্ত্রণে অনিরাপদ এ যান সড়ক-মহাসড়ক দাবড়ে বেড়ালেও যেন দেখার কেউ নেই। নসিমন, করিমন, ভটভটি আর আলমসাধুর চলাচল বন্ধে হাই কোর্টের দেওয়া কঠোর নির্দেশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ থেকে এসব অনিয়ন্ত্রিত থ্রি-হুইলার চলা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু অবৈধ এ যানবাহনের খাত থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির কারণেই পুলিশের সহায়তায় নসিমন, করিমন, ভটভটি নির্বিঘ্নে চলছে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল আর সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র মিলে মৃত্যুফাঁদ খ্যাত এসব যান চলাচল জিইয়ে রেখেছে।

সরকারের প্রজ্ঞাপনে যে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ থ্রি-হুইলার বন্ধ করা হয়েছিল সেগুলো হলো- কাঁচপুর সেতু থেকে মদনপুর-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম-রামু (কক্সবাজার)। কাঁচপুর সেতু-ঢাকা-ভেলানগর (নরসিংদী)-ভৈরব-সরাইল-মাধবপুর-মিরপুর-শেরপুর-সিলেট বাইপাস। জয়দেবপুর চৌরাস্তা-ময়মনসিংহ বাইপাস পয়েন্ট। জয়দেবপুর চৌরাস্তা-টাঙ্গাইল-জামালপুর। আমিনবাজার সেতু ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া ঘাট-খয়ের চর ঘাট-কাশিনাথপুর-হাটিকুমরুল-বগুড়া বাইপাস-রংপুর বাইপাস-সৈয়দপুর বাইপাস-দশমাইল (দিনাজপুর)-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা। কাশিনাথপুর (পাবনা)-পাবনা বাইপাস-দাশুরিয়া-নাটোর বাইপাস-রাজশাহী বাইপাস-নবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ-বালিয়াদীঘি স্থলবন্দর। দৌলতদিয়া-ফরিদপুর (রাজবাড়ী মোড়)-মাগুরা-ঝিনাইদহ বাইপাস-যশোর বাইপাস-খুলনা সিটি বাইপাস-মোংলা। তেগোরিয়া মোড় (ঢাকা)-মাওয়া-কাওড়াকান্দি-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী। ময়নামতি (কুমিল্লা)-ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাইপাস-সরাইল। মদনপুর-ভুলতা-মীরের বাজার-বোগড়া-কড্ডা (ঢাকা বাইপাস)। এলেঙ্গা-নলকা-হাটিকুমরুল। বগুড়া-নাটোর। রংপুর-বড়বাড়ী-কুড়িগ্রাম। হাটিকুমরুল-বনপাড়া। বড়বাড়ী-লালমনিরহাট-বুড়িমারী। নবীনগর-ইপিজেড-চন্দ্রা। যশোর-মাগুরা। ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-দাশোরিয়া। চাঁষড়া মোড় (যশোর)-বেনাপোল। ভাঙ্গা-ফরিদপুর বাইপাস-রাজবাড়ী মোড়। ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া-মোল্লাহাট-ফকিরহাট-নোয়াপাড়া ও ভাটিয়াপাড়া-কালনা-লোহাগড়া-নড়াইল-যশোর।

সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনা হ্রাস করতে হলে বিপজ্জনক অটোরিকশা, থ্রি-হুইলার চলা বন্ধ করতে হবে। মহাসড়কগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে ভারী যান চলার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কঠোরভাবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারলে দুর্ঘটনামুক্ত মহাসড়ক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এসব ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর