শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশ বদলে দেবে হালকা প্রকৌশলশিল্প

প্রায় ১৬ লাখ শ্রমিক ছোট-বড় ৪০ হাজার কারখানায় ♦ দেশীয় বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার, বিনিয়োগ সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার ♦ বিশ্ববাজারের চাহিদা সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার ♦ বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩১৯ মিলিয়ন ডলার

রুহুল আমিন রাসেল

দেশ বদলে দেবে হালকা প্রকৌশলশিল্প

যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। অবাঙালিদের কারখানায় কাজ করতেন কিছু বাঙালি টেকনিশিয়ান, কিছু মেশিন অপারেটর। তারাই পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডে গড়ে তোলেন গুটিকয় কারখানা। শুরু হয় বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরি। তাদের অর্থায়ন ও বিকাশে ‘ধোলাইখাল জিঞ্জিরা প্রকল্প’ নেয় সরকার। সেই  যন্ত্রাংশ তৈরির লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং বা হালকা প্রকৌশলশিল্প কারখানাগুলো আজ ছোট-বড় মেশিন তৈরি করছে। মিটছে দেশীয় চাহিদা। হচ্ছে রপ্তানি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে দেশই বদলে দেবে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। রপ্তানির সম্ভাবনা বিবেচনায় বছরের প্রথম দিনই ২০২০ সালকে হালকা প্রকৌশল শিল্পবর্ষ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হালকা প্রকৌশলশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইওয়া) তথ্যমতে, বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ উৎপাদনশীল আর ৯০ শতাংশই সেবা ও মেশিন মেরামতের কারখানা। এতে প্রায় ৬ লাখ দক্ষ শ্রমিকের সঙ্গে অর্ধদক্ষ ১০ লাখ মিলিয়ে মোট কাজ করছেন প্রায় ১৬ লাখ শ্রমিক। প্রায় ১৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গড়ে ওঠা এই হালকা প্রকৌশলশিল্পের দেশীয় বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আমদানিবিকল্প যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে এ খাত। আর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সেবার মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান রাখছে। বিশ্ববাজারের সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার চাহিদার বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাত্র ৩১৯ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলারের ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হাওয়া এ শিল্পের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অবদান প্রায় ৩ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি ২০২০ সালে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে জাতীয়ভাবে ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করে এ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। সম্ভাবনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এ শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিনিয়োগ ও সোর্সিংয়ের জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এ শিল্পের বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রপ্তানির সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা হবে। এ খাতের পণ্যসমূহের মধ্যে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোমোবাইল, অটোপার্টস, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি, সোলার ফটোভলটিক মডিউল, খেলনা প্রভৃতি রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইওয়া) সভাপতি মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘অর্থনীতিতে হালকা প্রকৌশলশিল্পের ওপর নির্ভর করে চীন, জাপান, তাইওয়ান ও কোরিয়ার উত্থান হয়েছে। আছে দেশি-বিদেশি বিশাল বাজার। এখন আমাদের প্রয়োজন নীতিসহায়তা। দরকার টেকসই পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপন। উদ্যোক্তাদের জন্য লাগবে নিরাপদ বিনিয়োগ ও অর্থায়নের নিশ্চয়তা।’

বাইওয়ার তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে গুটিকয় কারখানা চালুর মাধ্যমে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের যাত্রা হয়। প্রথমে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও যানবাহনের কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মধ্যেই সীমিত ছিল। পরে এ শিল্পের বিকাশ ও অর্থায়নে ১৯৮৬ সালে ‘ধোলাইখাল জিঞ্জিরা প্রকল্প’ গ্রহণ করে সরকার। ঋণের জন্য ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর পরই এ খাত বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভ করে। পরে সারা দেশে এ শিল্প ছড়িয়ে দিতে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে আরেকটি ‘ধোলাইখাল জিঞ্জিরা মডেল প্রকল্প’ গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। ফলে কারখানা বৃদ্ধি পেয়ে আজ প্রায় ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, হালকা প্রকৌশলশিল্পকে মাদার ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়। মূলত কোনো খাতে শিল্প স্থাপন করার জন্য যেসব মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ প্রয়োজন হয়, তা উৎপাদন করে হালকা প্রকৌশল খাত। শিল্পকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও এ খাতেই উৎপাদন হয়। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিপেয়ারিং, সার্ভিসিংসহ পরিচর্যার কাজটিও করে হালকা প্রকৌশলশিল্প।

হালাক প্রকৌশলশিল্পের সমস্যা : বর্তমানে শিল্পের মূলধনি মেশিনারি আমদানি পর্যায়ে ১ শতাংশ শুল্ক ও মূসক অব্যাহতি রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক শিল্পায়নের জন্য সহায়ক। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বহাল থাকা উৎপাদন পর্যায়ে মূসক নজিরবিহীন বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। মূলধনি যন্ত্র বাণিজ্যিকভাবে আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ৫ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক এসএমই শিল্পায়নের জন্য অব্যাহতি চান এ খাতের উদ্যোক্তারা। মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ককর আরোপ করা হলেও একই পণ্য দেশে তৈরি করতে গিয়ে কাঁচামালের কর দিতে হয় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ। দেশে শিল্পায়নের স্বার্থে শুল্ককর যৌক্তিকীকরণের দাবি হালকা প্রকৌশলশিল্প মালিকদের।

আধুনিক শিল্পপার্ক স্থাপনের দাবি : দেশের যেসব স্থানে চাহিদা আছে, সেখানে সমন্বিত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত পরিকল্পিত ও আধুনিক শিল্পপার্ক স্থাপনে সরকারের উদ্যোগ চান ব্যবসায়ীরা। এসব শিল্পপার্কে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, কমন ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, গ্রিন পার্ক, নিরাপত্তাব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত থাকতে হবে। স্থায়ী ট্র্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবি : লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (বিএলইটিআই) মাধ্যমে এ খাতে কর্মরত কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও চাহিদা পূরণে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাইওয়া। নতুন কারিগর তৈরি করতে রয়েছে ট্রেড কোর্স। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরেও চলছে প্রশিক্ষণ। তবে এসব কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য নিজস্ব কোনো অবকাঠামো নেই। ফলে প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থই ভাড়ায় চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বাইওয়া। এ খাতের উন্নয়নে স্থায়ীভাবে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাছে ২০ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছে বাইওয়া।

সর্বশেষ খবর