রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জমজমাট হয়ে উঠছে অবৈধ এমএলএম প্রতারণা। সরকার এমএলএম বাণিজ্য নিষিদ্ধ করলেও নানা কৌশলে আর অভিনব সব পন্থায় এই প্রতারণা বাণিজ্য। আবাসনসহ নানা ব্যবসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এর আড়ালেই চলছে এমএলএমের ফাঁদ। বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ এসব ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন নিজেদের সহায় সম্বল। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব প্রতারণা ব্যবসা। এ কারণে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। উল্টো তাদেরই হয়রানির ভয় দেখানো হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরার ৭ নং সেক্টরে একটি আবাসন কোম্পানির নামে চলছে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ন্যূনতম ২০ হাজার বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অফেরতযোগ্য সদস্য ফি আদায় করেছে। জনপ্রতি ১২ হাজার ৩০০ টাকা করে অফেরতযোগ্য সদস্য ফি বাবদই সংগ্রহ করে নিয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। মোটা অংকের লাভের প্রলোভন দেখিয়ে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আমানত হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আবাসন কোম্পানি বলে দাবি করলেও তাদের প্রকল্পগুলোর অবস্থান জানাতে পারছে না কেউ। রাজউক, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রকল্পের নিবন্ধন বা অনুমোদন নেই। আজ পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে এক খ- জমি বা প্লট বুঝিয়ে দেওয়ারও নজির মেলেনি। জানা গেছে, জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড ফার্মস্ থেকে নিবন্ধন করিয়েই ছয় বছর ধরে নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা ফেঁদে বসেছে সংস্থাটি।
উত্তরা ১২ নং সেক্টরে একই নামের রয়েছে ফ্যাশন, ট্রাভেলস, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের লিমিটেড প্রতিষ্ঠান। সুসজ্জিত কার্যালয় খুলে আমানতকারীদের প্রতি লাখে ৮ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দিয়ে সংগ্রহ করা হচ্ছে আমানত। আমানতকারী সংগ্রহ করে দেওয়া দালালরা পাচ্ছেন শতকরা ১০ ভাগ কমিশন। উত্তরার আগে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ইসিবি চত্বর মানিকদী রোডের ৬৯৫/২/জি নম্বরের ভবনে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেখানেও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন তিনি। খিলক্ষেত থানাধীন নিকুঞ্জ-২-এ অবস্থিত জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড ফার্মস্ কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান। এক বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানটির সুসজ্জিত অফিস হলেও কোথাও কোনো আবাসন প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আবাসন কোম্পানির অন্তরালে চলছে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা। বিভিন্ন চমকপ্রদ প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শিকার ধরে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ও স্বল্পআয়ের মানুষ তাদের প্রধান টার্গেট। প্রলুব্ধ করা হয়, এই প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করলে বাড়ি, গাড়ি, টেলিভিশন, ল্যাপটপ প্রভৃতি উপহার হিসেবে দেওয়া হবে। আমানতকারীদের প্রতি লাখে মাসে ৭ হাজার ৩০০ টাকা করে লাভ দেওয়ার প্রলোভনেও প্রলুব্ধ করা হয়। জানা গেছে, এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। খিলক্ষেত থানা-পুলিশের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেই বেজায় দাপটের সঙ্গে এই অবৈধ এমএলএম বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করেও খিলক্ষেত থানার ওসির কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ড্রইং রুমে অফিস, রান্নাঘরে বসেন জিএম : পল্লবীর দোয়ারীপাড়ার বালির মাঠ এলাকায় সবুজ ছায়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কথিত এ কার্যালয়ের সামনে টানানো সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘সবুজ ছায়া-রেজি নং ২০৪, নিবন্ধনের তারিখ ২৭/০৩/২০১৪।’ সমবায় অধিদফতরে যোগাযোগ করে কাগজপত্রে ব্যবহৃত মর্মে সবুজ ছায়া নামক কোনো সমিতি, সংগঠন বা সংস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। হোল্ডিং নম্বরবিহীন ভাড়া নেওয়া বাসার ড্রইং রুমকে অফিস হিসেবে সাজিয়েছেন, রান্নাঘরকে বানানো হয়েছে জেনারেল ম্যানেজারের চেম্বার। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বস্তিসদৃশ তার বাসা কাম অফিস ঘিরে শত শত মানুষের আনাগোনা। বিশেষ করে সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া কর্মচারীরা তাদের পেনশনের বিপুল পরিমাণ টাকা রাতারাতি লাভের আশায় নিজামউদ্দিনের সমিতিতে আমানত রেখেছেন। তাদের মাঝে পুঁজিরই একটি অংশ মাসে মাসে ‘লভ্যাংশ’ হিসেবে প্রদানের উদাহরণ দেখিয়েই রাতারাতি কয়েকশ মানুষের কোটি কোটি টাকা আমানত হাতিয়ে নেওয়া হলেও মালিককে কোনো ধরনের বেগ পেতে হয়নি। তবে সবুজ ছায়ার কথিত চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন জানান, বিনিয়োগের টাকা সমিতির আওতায় লাভে খাটিয়ে আয় করি। আবার বড় বড় তদবির কন্ট্রাক্টের কাজেও ব্যবহার করা হয় আমানতের টাকা। কোন কাজে ব্যবহার করলাম সেটা বড় কথা নয়, গ্রাহকরা লাভ পাচ্ছে কিনা সেটা বড় কথা। বেশ কয়েক বছর আগে ‘নিউওয়ে’ নামের একটি এলএমএল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছিল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ। এবার একটি আবাসন কোম্পানির ব্যানারে নতুন কৌশলে ‘নিউওয়ে’-র মালিকরা খুলেছেন অভিনব প্রতারণা। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে ‘স’ আদ্যাক্ষরের এক মালিক আবাসন ব্যবসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন সরকার নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা। ব্যাপক প্রতারণা শেষে ব্রাইট ফিউচার লিমিটেড থেকে গা-ঢাকা দেওয়া এক মালিক আবার প্রতারণার নতুন ফাঁদ পেতেছেন আবাসন কোম্পানির মোড়কে। অফারে উল্লেখ করছেন, প্রতি লাখে মাসে ছয় হাজার টাকা। এ ছাড়া ১৬ মাসে আমানত দ্বিগুণ। গত দুই বছরে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সম্পূর্ণ লাভের টাকায় স্বপ্নের প্লট-বাড়ি পাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আমানত সংগ্রহের দৌরাত্ম্য চলছেই। ফাইভ স্টার হোটেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে যমুনা ফিউচার পার্ক সংলগ্ন উল্টো পাশের গলিতে খোলা হয়েছে এক কথিত আবাসন প্রতিষ্ঠান। গত ৬-৭ মাসে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।