মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় অর্থসংকট, ব্যয়ের লাগাম টানছে সরকার

মানিক মুনতাসির

করোনায় অর্থসংকট, ব্যয়ের লাগাম টানছে সরকার

বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়া কভিড-১৯-এর কারণে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ধস নেমেছে সরকারের আয়ে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই আর্থিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এজন্য সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের সরকারি গাড়ি। ফলে মৌলিক প্রয়োজনের বাইরে খরচ করতে চাইছে না সরকার। এজন্য উন্নয়ন ও পরিচালন উভয় ধরনের ব্যয় সংকোচন নীতি সরকার বেছে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিলাসী ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ, এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও যাতায়াত খরচ কমানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। এজন্য বেশির ভাগ সভা অনলাইনে করা হচ্ছে। এতে করোনার সংক্রমণ ঝুঁকিও কম বলে মনে করে সরকার। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে প্রণোদনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতির কারণেই সরকার ব্যয় সংকোচনে নেমেছে। এরই মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় বন্ধ করা হয়েছে। একইভাবে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ-সংক্রান্ত পরিপত্রও জারি করেছে অর্থ বিভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরসূত্র জানান, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এটি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা কম।

এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যানুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে যা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। বিপরীতে অর্থবছর শেষে আদায় হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এটিও সাময়িক হিসাব। চূড়ান্ত হিসাবে ঘাটতি আরও বাড়বে।

চলতি বছরের শুরুতেও রাজস্ব আদায়ে ধাক্কার মুখে পড়েছে এনবিআর। কেননা করোনা মহামারীর কারণে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের ভয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন কমাচ্ছেন। কর্মী ছাঁটাই করছেন। ফলে বছর শেষে তাদের আয় কমে যাবে। এতে রাজস্ব প্রদানের পরিমাণও কমবে আশঙ্কাজনক হারে। এ ছাড়া মানুষের ভোগের মানসিকতা হ্রাস পেয়েছে। কেননা মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভ্যাট আদায়েও ধস নামবে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে।

আর প্রবৃদ্ধির হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর গঠনের পর প্রথমবারের মতো রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে প্রতি বছরই সামান্য হলেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এনবিআরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে, ৬৭ শমিক ২২ শতাংশ। আর ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে, ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। এবারই প্রথম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলো।

জানা গেছে, ব্যয় সংকোচন করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। নিম্ন অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পে অর্থছাড় আপাতত স্থগিত রয়েছে। আর ‘মধ্যম অগ্রাধিকার’ প্রকল্পের যেসব খাতে না করলেই নয়, এমন টাকা খরচের ক্ষেত্রে নিজস্বভাবে ও স্বীয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে। পাশাপাশি ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের’ অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখতে হবে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প এ নির্দেশের আওতার বাইরে থাকবে। জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ মোকাবিলায় সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন শ্রেণির জন্য ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ২০ হাজার কোটি, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয় শ্রেণির মানুষ ও কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে ১২ হাজার ৫০০ কোটি, প্রি-শিপমেন্ট ঋণ ৫ হাজার কোটি, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটিসহ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দেওয়া হয়। অন্যদিকে ৩০ জুন করোনাকালের নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি। পরিচালন ব্যয় (ঋণ, অগ্রিম ও দেনা পরিশোধ, খাদ্য হিসাব ও কাঠামোগত সমন্বয় বাদে) ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারা বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা বিরাজ করছে। এ সংকট সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে। ফলে এখানেও এর প্রভাব পড়েছে। এতে সরকারেরও আয় কমেছে। সরকার যে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এর আগে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে সরকারের অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে, যা এ সংকটকালে কাজে লাগবে বলে তিনি মনে করেন।

 

সর্বশেষ খবর