শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্ভোগ চরমে, নদীগর্ভে একাধিক স্কুল

খারাপ হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্ভোগ চরমে, নদীগর্ভে একাধিক স্কুল

বন্যার পানিতে ডুবে যাচ্ছে সবকিছু। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ভবনসহ নানা স্থাপনা। উদ্বোধনের আগেই গতকাল চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে তলিয়ে গেছে স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রটি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২১ জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন পানিবন্দী। আজকের মধ্যে আরও অবনতি হতে পারে ছয় জেলার বন্যা পরিস্থিতির। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় চরাঞ্চলে ত্রাণও পৌঁছাচ্ছে খুবই কম। ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা রকম পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত বানভাসিরা। প্রতিদিনই বন্যার পানিতে ডুবে কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই গত তিন সপ্তাহে বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে ৮৬ জন মারা গেছে। নদীভাঙনে বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলার মানচিত্র। বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। উদ্বোধনের আগেই গতকাল সকালে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে চাঁদপুরের ‘রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চবিদ্যালয়’ নামে তিনতলা স্কুলটি। বিকালে পদ্মায় বিলীন হয়ে যায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবন। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে ৫৭টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০টি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজকের মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ ছাড়া স্থিতিশীল থাকতে পারে সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানিসমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানিসমতল স্থিতিশীল আছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহের পানিসমতল বৃদ্ধি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বালু নদীর পানি ডেমরা পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। কুশিয়ারা ব্যতীত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানিসমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানিসমতল হ্রাস পেতে পারে এবং ধরলা নদীর পানিসমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি-  চাঁদপুর : বন্যায় চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়েছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। উদ্বোধনের আগেই গতকাল সকালে মেঘনার গর্ভে হারিয়ে গেছে চাঁদপুরের ‘রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চবিদ্যালয়’ নামে তিনতলা স্থাপনাটি। দুই কোটি ২৯ লাখ টাকায় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি নির্মাণ শেষে মাত্র দুই মাস আগে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মাদারীপুর : শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের বাতিঘর খ্যাত সেই বিদ্যালয়টি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনে নূরুদ্দিন মাদবরেরকান্দি গ্রামে অবস্থিত এসইএসডিপি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি মাঝ বরাবর দ্বিখন্ডিত হয়ে হেলে পড়ে বুধবার মধ্যরাতে। গতকাল বিকালে বিদ্যালয়টি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চলে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাচ্ছে চরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়াও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। লালমনিরহাট : ধরলা নদীর পানি গতকাল সকালে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকাল ৫টায় ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তার পানি কিছুটা কমেছে। পানি কমলেও দুর্ভোগ কাটেনি বানভাসিদের। এখনো ডুবে আছে ঘরবাড়ি। দীর্ঘদিন পানিবন্দী বসবাসের কারণে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সীরা। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট চরমে। গবাদি পশুগুলোও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নাটোর : সিংড়ায় বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার পরও আত্রাই নদীতে ২৪ ঘণ্টায় ৭ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতিমধ্যে উপজেলার আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একদিকে ভারি বর্ষণ, অন্যদিকে নদীর পানি বৃদ্ধি নাকাল করে দিয়েছে সিংড়া উপজেলার অন্তত নয়টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার জনসাধারণকে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পুরো উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন এবং পৌরসভা পানিতে নিমজ্জিত হবে বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো। রাজবাড়ী : ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে গতকাল বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার সদর, গোয়ালন্দ ও পাংশা উপজেলার প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। পানিবন্দী মানুষের খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

 বিশেষ করে গো-খাদ্য সংকট চরমে রয়েছে। গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, গোয়ালন্দ উপজেলার পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার। রাজবাড়ী সদর ও পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বলেন, তাদের দুই উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।

সুনামগঞ্জ : অপরিবর্তিত রয়েছে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি। বৃহস্পতিবারও জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। টানা তিন দফা বন্যায় বিপর্যস্ত জেলার জনজীবন। পানিবন্দী লাখো মানুষ। অনেকগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যাতায়াত ব্যবস্থা। ঘরবাড়ি ও গো-চারণভূমিতে পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছে মানুষ। তৃতীয় দফায় বন্যা প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ পৌরসভার বেশির ভাগ এলাকা।

সিলেট : দুই দফা বন্যার রেশ কেটে ওঠার আগেই ফের বন্যার মুখে পড়েছে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা। পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে তৃতীয় দফায় প্লাবিত হয়েছে উপজেলার নিম্নাঞ্চল। ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকের কাঁচাঘর, রাস্তাঘাট, বীজতলা, ফসলি জমি, সবজি খেত, ভেসে গেছে মৎস্য খামার ও পুকুরের মাছ। এর মধ্যে ফের পানি বৃদ্ধি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে জনমনে। গবাদিপশু নিয়েও বেকায়দায় রয়েছেন কৃষকরা। চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন পানিবন্দী প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. কামরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। পানিবন্দীদের মধ্যে শুকনো খাবারসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।  

জামালপুর : তৃতীয় দফায় যমুনাসহ শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আবারও পানি বৃদ্ধি ও অবিরাম বর্ষণে চরম দুর্ভোগে রয়েছে পানিবন্দী ১০ লাখ মানুষ। দুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার, সুপেয় পানি, শিশু খাদ্য, গো-খাদ্যের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার বকশীগঞ্জ উপজেলায় পানিতে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ও জগন্নাথগঞ্জঘাট পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

গাইবান্ধা : টানা বন্যা ও গত দুই দিনের বৃষ্টিতে গাইবান্ধায় বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রিত বানভাসি মানুষ গত জুন মাসের ২৫ তারিখ থেকে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বন্যা দীর্ঘ হওয়ায় তাদের খাদ্যাভাব, বিশুদ্ধ পানি, টয়লেট সমস্যা এবং গবাদিপশুর খাদ্য সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। যদিও সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে তবে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম হওয়ায় সবাই ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন বানভাসিরা।

শরীয়তপুর : শরীয়তপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের। শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শরীয়তপুরের বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। প্রচ- বৃষ্টিপাত আর উজান থেকে বন্যার পানি নেমে এসে শরীয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও শরীয়তপুর সদর  উপজেলার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, মৎস্য খামার, ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের অভাব। আবার অনেকে রান্না করতে না পেরে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। একবেলা খেতে পারলেও আরেক বেলা খেতে পারছে না বন্যাকবলিত মানুষ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর