বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

নিলামের মাল দরিয়ায় ঢাল

নিলাম করা ম্যাজিস্ট্রেটকে শোকজ

তুহিন হাওলাদার

ফৌজদারি অভিযোগে জব্দ করা গুরুত্বপূর্ণ বহু আলামত গোঁজামিল দিয়ে নিলামে বিক্রি করায় নানা প্রশ্ন উঠেছে এক ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার আদালতপাড়ায় গুঞ্জনও চলছে। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার সত্যতা পেয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) এ এম জুলফিকার হায়াত সম্প্রতি নিলাম কমিটির সদস্য ঢাকার ২২ নম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আতিকুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিসও দিয়েছেন। এ ছাড়া নিয়ম না মেনে নিলাম কার্যক্রম নিষ্পত্তি করা বিগত দুই বছরের তিন শতাধিক নথিপত্র যাচাই-বাছাই করতে তালাশ করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। আদালত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকার কারণেই নিলামের মাল দরিয়ায় ঢালা হয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, ওই নোটিসে বলা হয়েছে, ঢাকার সিএমএম আদালতের বিভিন্ন দফতর ও শাখা পরিদর্শনকালে গোচরীভূত হয়েছে যে, নিলাম কার্যক্রম আইনসম্মতভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এ ছাড়া নিলাম কার্যক্রমে কোনো ধরনের রেজিস্টার রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আতিকুল ইসলামের নিষ্পত্তি করা ছয়টি নিলামে অনিয়ম প্রাথমিকভাবে গোচরীভূত হয়। এর মধ্যে (১) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-৬৫৯, তারিখ ১১/০৪/২০১৬, (২) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-৯৩২, তারিখ ১৫/১১/২০১৮, (৩) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-১৩০, তারিখ ০২/০৬/২০১৬, (৪) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-১০৩৩, তারিখ ২০/১২/২০১৬, (৫) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-১২২১, তারিখ ২৯/০৭/২০১৭, (৬) উত্তরা পশ্চিম থানার জিডি নম্বর-১১১১, তারিখ ২১/০৭/২০১৬। এ ছয়টি নিলাম বিক্রির নথিতে জব্দ করা ছয়টি মোটর সাইকেল তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মো. জাহিদুল কবির ০৪/০৮/২০১৯ তারিখে নিলাম বিক্রির জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আতিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেন। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আতিকুল ইসলাম ১৭/১০/২০১৯ তারিখ নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন এবং ১০/০৬/২০২০ তারিখ চূড়ান্তভাবে নিলামকাজ সম্পন্ন করেন। ওই তারিখে বিক্রি করা নিলামের টাকা চালানমূলে ১-২১৪১-০০০০-২৬৮১ নম্বর কোডে জমা করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট  (সিএমএম) এ এম জুলফিকার হায়াত সম্প্রতি নিলাম কমিটির সদস্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আতিকুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছেন। কারণ দর্শানোর নোটিসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী সংক্রমণ রোধকল্পে ২৯ মার্চ থেকে আদালতের নিয়মিত কর্যক্রম (জরুরি জামিন ও অতীব জরুরি বিষয়সমূহ ব্যতীত) মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বন্ধ থাকে। কিন্তু আপনি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করে উক্তরূপ নিলাম কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করেন এবং উক্ত তারিখ (২০/০৬/২০২০) নিলামের টাকা চালানমূলে জমা প্রদান করেন। তদুপরি আপনি নিলাম বিক্রির টাকা ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার ২০০৯-এর ভলিউম ১-এর ৫০৬ বিধিতে (উক্ত বিধির নোট ২ ও ৩) উল্লিখিত বিচার বিভাগের নির্ধারিত কোডে জমা প্রদান না করে ভিন্ন কোডে জমা প্রদান করেছেন, যা আইনবহির্ভূত এবং বিচারিক কাজে ভয়াবহ গাফিলতির শামিল। এ ছাড়া আপনি নিলাম কার্যক্রমের কোনো ধরনের রেজিস্টার আইনসম্মতভাবে সংরক্ষণ করেন নাই। এমনকি নিলামের নথি-সংশ্লিষ্ট সাধারণ ডায়েরির (জিডি) কোনো কপি নাই। এ কারণে প্রতীয়মান হয় যে, বিক্ষিপ্তভাবে পছন্দসই আলামত নিলাম করে বিক্রি করা হয়েছে। তদুপরি নিলামের নথিসমূহ আপনি ব্যক্তিগতভাবে আপনার হেফাজতে রেখেছেন। এ ছাড়া নিলাম কার্যক্রম অনুষ্ঠানের জন্য আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করে ০৮/০১/২০১৯ তারিখের ১৪ নম্বর আদেশ অনুসারে একটি নিলাম কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যা বিগত ২৪/১০/২০১৯ তারিখে পুনর্গঠন করা হয়। সেই নিলাম কমিটিতে আপনিসহ আরও দুইজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) থাকলেও নিলাম কার্যক্রমে ওই দুই সদস্যের (দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা দেখা যায় না। এমনকি নিলাম কার্যক্রমে কমিটির ওই দুই সদস্যের (দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) কোনো ধরনের স্বাক্ষর পর্যন্ত নাই। এতে প্রতীয়মান হয়, আপনি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম এককভাবে বিধিবিধান না মেনে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার মানসে উপরিউক্ত নিলামসমূহ সম্পন্ন করেন। এ বিষয়ে আপনাকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ প্রদান করা হলো এবং একই সঙ্গে আপনার নিকট নিলাম কার্যক্রম সংক্রান্তে অনিষ্পন্ন বা নিষ্পন্ন হিসাবে রক্ষিত সমস্ত নথির তালিকা প্রস্তুত করে ঢাকার সিএমএমের দফতরে জমা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হলো।’ আদালত সূত্র আরও জানায়, নিষ্পত্তি করা মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) মূলে জব্দ করা দামি গাড়ি বিএমডব্লিউসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও হরেক রকম আলামত থানা থেকে আদালতের নেজারত শাখায় নিলামের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। ওই আবেদন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট যাচাই করার জন্য নিলাম কমিটির কাছে মতামত দেওয়ার জন্য পাঠান। নিলাম কমিটি যাচাই-বাছাই করে নিলামের বিষয়ে মতামত প্রদান করে (কোনটা নিলাম হবে আর কোনটা হবে না)। পরে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিলাম প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য নিলাম কমিটির কাছে দায়িত্ব দেন। নিলাম কমিটি নিলামযোগ্য মালামাল সর্বনিম্ন ১৫ দিনের সময় দিয়ে নিলামের নোটিস/বিজ্ঞপ্তি দেয়। এ ছাড়া জব্দকৃত মালামাল প্রকাশ্যে নিলাম অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত তারিখ ও স্থানে মালামাল-সংশ্লিষ্ট অফিসার উপস্থাপন করেন। এ সময় নিলামে অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতাকে নিলামের টাকা পরিশোধের জন্য নেজারতের মাধ্যমে ব্যাংকে চালান দেওয়ার শর্তে আদেশ দেওয়া হয়। পরে নিলামকৃত মালামালের বিবরণ, নিলামকৃত মামলা অথবা জিডি নম্বর, নিলামের তারিখ, নিলামপ্রাপ্ত ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা, প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্র, নিলামের চালান নম্বর, নিলামকৃত টাকার পরিমাণ, নিলামের টাকা জমা দেওয়া ব্যাংক ও শাখার নাম লিখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নেজারতের নিলাম শাখায় একটি অফিস ফাইল রাখা হয়। কিন্তু বিগত দিনে প্রায় দুই বছর ধরে নিলাম কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এ ধরনের নিয়ম না মানার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন করা বিগত দিনের তিন শতাধিক নথিপত্র যাচাই-বাছাই করার জন্য খোঁজা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর