সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

নীল পাহাড়ে চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি

মোস্তফা কাজল, চট্টগ্রাম থেকে ফিরে

নীল পাহাড়ে চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি

নীল পাহাড়ে আলাদা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থল এ ওয়ার সিমেট্রি। এটি এখন চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন স্পট। নীল সতেজ প্রকৃতির মাঝে একটু স্বচ্ছ নিঃশ্বাস নিতে অনেকে আসেন। পুরো এলাকায় বিরাজ করছে নীলে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। আগতদের মধ্যে তরুণ-তরুণীই বেশি। অনেকে অবসর কাটানোর জন্য প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরতে আসেন। চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র মেহেদীবাগ ও গোল পাহাড় এলাকায় এটি অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্দো-বার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে মিত্রবাহিনীর যেসব সৈনিক প্রাণ হারায় তাদের সমাহিত করা হয় চট্টগ্রামের এ নীলাভ প্রাকৃতিক পরিবেশে। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এ ওয়ার সিমেট্রিকে দেওয়া হয়েছে নান্দনিক রূপ। পাহাড়ের ভাঁজে অপরূপ এক সমাধিস্থল। এলাকাটি দেখতে অনেকটা নীলাভ মনে হবে। এজন্য অনেকে এ স্থানকে নীল পাহাড়ের দেশ বলেও অভিহিত করেন। সিমেট্রির ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে পাশাপাশি শায়িত পাঞ্জাব-২ রেজিমেন্টের দুই সৈনিক অমর সিং আর গুলাম মোহাম্মদের সমাধি। একজনের সমাধিফলকে হিন্দি আর অন্যজনের উর্দুতে স্বজনরা জানিয়েছেন অন্তিম শুভেচ্ছা। ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন ধর্ম মৃত্যুর পরও ভাঙতে পারেনি তাদের বন্ধুত্ব।

সময়টা ১৯৩৩ সাল। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ জেল খেটেছেন। এবার তিনি ভীষণ সতর্ক। উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব নেই। তবে গায়ের জোরে নয়, কথার জাদুতেই জার্মানদের ভোলালেন চ্যান্সেলর হিটলার। যেহেতু হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবের ফলে জার্মানরা পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এরপর ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করল পার্ল হারবার। বেধে গেল বিশ্বযুদ্ধ। পার্ল হারবারের পর জাপানিরা মালয়-সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) দিকে এগোতেই নড়েচড়ে বসলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। রেঙ্গুনের পতনের পরপরই ব্রিটেনের ঘাঁটি উঠে আসে চট্টগ্রামে। ঘাত-প্রতিঘাত আর রক্তক্ষরণের পর আসে ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাস। বিখ্যাত রেড আর্মি ক্রমে ঘিরে ফেলেছে বার্লিন। ৩০ এপ্রিল সকালে জেনারেল হেলমুট ওয়েলডিং এসে হিটলারকে জানালেন যে, সোভিয়েত বাহিনী তাদের বাঙ্কারের প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে এসে পড়েছে। গোলাবারুদ যা আছে তা দিয়ে ২৪ ঘণ্টাও টেকা যাবে না। আতঙ্কিত জেনারেল ওয়েলডিং আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন জবাবের জন্য। এরপর ফিরে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এ ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করলেন অ্যাডলফ হিটলার। পাশেই সায়েনাইড খেয়ে পড়ে রইলেন তার নবপরিণীতা স্ত্রী ইভা ব্রাউন। আর সঙ্গে সঙ্গে পর্দা পড়ে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটির। নীল পাহাড়ের ওপর নির্মিত চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে সৈনিকদের মৃতদেহগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মাটিতে। কিন্তু এ সমাধিক্ষেত্র আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত আর নির্মমতার চিহ্ন ধারণ করে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীন। তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীসহ মিত্রবাহিনীর অনেক সৈন্যকে অংশ নিতে হয়েছিল এ যুদ্ধে। যার বেশির ভাগেরই আর রণাঙ্গন থেকে ফেরা হয়নি। চিরকালের মতো স্থান হয়ে গেছে চট্টগ্রামের মাটিতে। চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয় মূলত আসামের লুসাই পাহাড়, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে নিহত সৈন্যদের মৃতদেহগুলো। এতে আছে ব্রিটেন, কানাডা, অবিভক্ত ভারত, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ৭৫৫ জন সৈন্যের সমাধি। আছে সে সময়কার শত্রুপক্ষ জাপানের ১৯ জন সৈন্যের মৃতদেহ। ব্রিটেনের রয়াল আর্টিলারির ২৪ বছর বয়সী গানার জে এফ হ্যালিডের সমাধির ফলকে তার প্রেয়সী লিখেছিলেন- আমি তোমার অপেক্ষায় জেগে থাকব।

সর্বশেষ খবর