মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সারা দেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মহাপরিকল্পনা

শামীম আহমেদ

সারা দেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মহাপরিকল্পনা

দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছরেও শহর-গ্রাম কোথাও নেই সুষ্ঠু পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা। খালে, বিলে, নদীতে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে মানববর্জ্য। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি, বাতাস। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৬.২ অর্জন। তবে এসডিজি অর্জনে সরকার এবার সারা দেশের পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়েছে ১২ বছর মেয়াদি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা। মেগাসিটি ঢাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও পল্লী অঞ্চলে পৃথক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে আধুনিক পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনাসেবা চালুসহ সবার জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। ২১টি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, এসডিজি ৬.২ অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনরীতিতে অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ফোরামের ১৬তম সভায় বাংলাদেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৭ সালে কাঠামোটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। কাঠামো বাস্তবায়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ২০১৮ সালের জুনে সরকারি সংস্থা, দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃত্বে ইতিমধ্যে পৌরসভা ও পল্লী অঞ্চলের জন্য পৃথক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ শেষের পথে। মেগা সিটি ঢাকার জন্য তৈরি হচ্ছে আলাদা কর্মপরিকল্পনা। ইতিমধ্যে কিছু পৌরসভায় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, করোনার কারণে মাঠপর্যায়ে কাজের গতি কিছুটা কম। তবে পেপারওয়ার্ক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকগুলো অনলাইনে চলছে। গত ১৮ অক্টোবর পৌরসভায় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে ৫০টি পৌরসভার মেয়র ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে এক অনলাইন কর্মশালায় যোগ দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশেও বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। সব ধরনের বর্জ্য এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে যাতে পরিবেশ দূষিত না হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের হানি না ঘটে। এ জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। যত ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার সরকার তার ব্যবস্থা করবে। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও একই ব্যবস্থা করতে হবে।

পৌরসভার কর্মপরিকল্পনা দেখা গেছে, ৩২৯টি পৌরসভায় তৈরি করা হবে পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগার (এফএসটিপি)। পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবহনের জন্য কেনা হবে আধুনিক সরঞ্জাম। পরিশোধনের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে জৈব সার, যা বিক্রি করে অর্থ আয় করবে পৌরসভাগুলো। ১৮৪টি পৌরসভায় এফএসটিপি তৈরির জন্য নিজস্ব জমি না থাকায় জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। সক্ষমতা অনুযায়ী চারটি ক্লাস্টারে পৌরসভাগুলোকে ভাগ করে বাস্তবায়ন করা হবে পরিকল্পনা। যতদিন পৌরসভাগুলোতে এফএসটিপি নির্মাণ না হবে, ততদিন নির্ধারিত জমিতে পরিখা খনন করে পয়ঃবর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা করবে পৌরসভাগুলো। নতুন ও পুরাতন কোনো ভবনে অনিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষ অনিরাপদ স্যানিটেশন নিষিদ্ধ বা সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকের শাস্তির ব্যবস্থা করবে। কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে নেওয়া হবে প্রচারণামূলক নানা পদক্ষেপ। ২০১৯ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এসব কাজ বাস্তবায়নে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। প্রথম তিন বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। একইভাবে পল্লী অঞ্চলের (উপজেলা/ইউনিয়ন পরিষদ) জন্য পৃথক কর্মপরিকল্পনায় ১২ বছরে মোট সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৬ কোটি ২৮ লাখ ৫২ হাজার ৮৬৪ টাকা। পৌরসভা নয় এরূপ শহর এলাকা ও অন্যান্য পল্লী অঞ্চল- এই দুটি ক্লাস্টারে ভাগ করে গ্রামীণ এলাকায় নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে। ইউনিয়ন এলাকার যেসব ভবনে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই, সেই ভবন মালিকদের নোটিস প্রদানসহ নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নির্মাণে নকশা, মিস্ত্রি, ঠিকাদারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করবে ইউনিয়ন পরিষদ। সংগৃহীত পয়ঃবর্জ্য থেকে জৈবসার, বায়োগ্যাস ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে নিয়মিত গবেষণা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার ব্যবস্থা করা হবে। পল্লী অঞ্চলের কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, খুলনা জেলায় ৩০ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই জনগোষ্ঠীর প্রতি পরিবারকে ল্যাট্রিন তৈরির জন্য দেওয়া হবে তিন হাজার টাকা। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৩৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব আয়, জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে অর্থের সংস্থান করা হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আইটিএন- এর পরিচালক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৌরসভা ও পল্লী অঞ্চলের কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে মেয়রদের মতামত চাওয়া হয়েছিল। অধিকাংশ মতামত চলে এসেছে। সবার মতামত পেলে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। মেগা সিটি ঢাকার জন্য এখনো কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়নি। এটা প্রক্রিয়াধীন। ঢাকার দুই মেয়র ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ওয়াসাসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বর্জ্যও একটা সম্পদ। এটা থেকে জৈব সার, বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ- এমন অনেক কিছু তৈরি সম্ভব। সখীপুরে পয়ঃবর্জ্য থেকে সার হচ্ছে। এটা বিক্রি করে আয় করা সম্ভব। তবে রাসায়নিক সারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে ভর্তুকি দিতে হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করবে।

সর্বশেষ খবর