বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কাস্টমার সার্ভিস কর্মকর্তার তথ্যে ব্ল্যাকমেইলিং

মাহবুব মমতাজী

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক জসিম (ছদ্মনাম)। বছর দেড়েক আগে ফোনে পারভীন আক্তার নূপুর পরিচয়ে তার কাছে চাকরি চান এক নারী। হঠাৎ একদিন নূপুর তাকে ফোন দিয়ে টাকা চান। উত্তরে জসিম তাকে বলেন, ‘আমি আপনাকে পাঁচ লাখ টাকা দেব কেন?’ জবাবে নূপুর তাকে বলেন, ‘আপনি এত দিন ধরে আমার সঙ্গে প্রেম করছেন। প্রেমের দাম দেবেন না?’ এসব ঘটনা শুরু হতো মোবাইল নম্বর ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের পর থেকে। এরপর অফিসে দেখা করে বা মোবাইল ফোনে কথা বলে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা। ফাঁদে ফেলতে মোবাইলে কথোপকথন রেকর্ড করে একসময় নিজেকে প্রেমিকা দাবি করে শুরু হতো প্রতারণা। কিছুদিন পর শুরু হতো ব্ল্যাকমেইলিং। কেউ ২ লাখ, কেউবা ২০ লাখ টাকা দিয়ে নিস্তার পেতেন। পরিকল্পিতভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে রাজধানীর হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এ কাজে তাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার। সিম নিবন্ধনে ব্যবহৃত যে কোনো ব্যক্তির তথ্য প্রয়োজন অনুসারে চক্রটিকে সরবরাহ করতেন তিনি। সমাজের উচ্চপদস্থ অনেকের কাছ থেকে চক্রটি এভাবে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা।

এর আগে ৩ ডিসেম্বর হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা হয়। এরপর মোহাম্মদপুর, নিকেতন, রমনা ও বাড্ডা থেকে গ্রেফতার হন পারভীন আক্তার ওরফে নূপুর, তার বড় বোন শেফালী বেগম, মতিঝিলের পারফেক্ট ট্রাভেল এজেন্সির কর্মচারী শামসুদ্দোহা খান ওরফে বাবু, ঈসা এবং মোবাইল ফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস সেন্টারের ম্যানেজার রুবেল মাহমুদ অনিক। এদের মধ্যে নূপুর ও অনিককে ৭ ডিসেম্বর তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। প্রথম দফায় ৬ ডিসেম্বর নূপুরকে এক দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের এমন অভিযোগ অসংখ্য। মামলার পরই অনুসন্ধান শুরু করেন তারা। চক্রটির টার্গেট ছিল মূলত ষাটোর্ধ্ব ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা। গ্রেফতার শামসুদ্দোহা খান বাবু ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজের সুবাদে বিদেশগামী বিশিষ্টজনদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে চক্রের হোতা নূপুরকে সরবরাহ করতেন। সমাজকর্মী বা চাকরিপ্রার্থী হয়ে ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি কিংবা ফোনে যোগাযোগ করেন নূপুর। ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর কথা মোবাইলে রেকর্ড করে শুরু হয় তার ব্ল্যাকমেইলিং। আবার কখনো টার্গেট করা ব্যক্তির সিম গ্রামীণফোনের হলে সার্ভিস সেন্টারের ম্যানেজার রুবেল মাহমুদ অনিকের কাছ থেকে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত ওই ব্যক্তির তথ্য টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতেন নূপুর। সেই তথ্যের সূত্র ধরেও শুরু হতো ব্ল্যাকমেইলিং। একপর্যায়ে ফোনো রেকর্ড তুলে ধরে সেই ব্যক্তির পরিবারকে জানানোর হুমকি দেওয়া হয়। দাবি করা হয় ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা। এই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আবির্ভাব ঘটে নূপুরের বড় বোন শেফালীর। বোনের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে নারী নির্যাতনের মামলার হুমকি দেন তিনি। মানসম্মানের ভয়ে টাকা দিতে বাধ্য হন ভুক্তভোগীরা।

অথচ দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই নূপুরের। অথচ রাজধানীর নিকেতনে ৮০ হাজার টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। আর শরীরচর্চার জন্য মাসে ব্যয় করেন ৩০ হাজার টাকা। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এ প্রতিবেদককে জানান, এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্ল্যাকমেইলিং চক্র। এদের কাছে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। লজ্জায় তারা অভিযোগ করতে চান না। সাত-আটজন আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই চক্রকে সমূলে উৎপাটনের পাশাপাশি এদের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা হবে। মোবাইল ফোন সার্ভিস সেন্টারের একজন কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে যেভাবে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত একান্ত গোপনীয় তথ্যগুলো পাচার করেছেন, সেখানে মোবাইল অপারেটরের গাফিলতিও খতিয়ে দেখা হবে।

তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক জানান, ৬০ বা তদূর্ধ্ব বয়সী বিভিন্ন পেশার মানুষকে এরা টার্গেট করে। অন্তত ২০ জনকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করার কথা স্বীকার করেছে তারা। এর মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক এবং উচ্চ বেতনধারী বেসরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে চক্রটি সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা নিয়েছে।

যেভাবে শুরু ব্লাকমেইলিং : শামসুদ্দোহা খান বাবু ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করার সুবাদে নিয়মিত বিদেশগামী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পদস্থ চাকরিজীবীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে নূপুরকে দিতেন। নূপুর নিজেকে কখনো সমাজকর্মী হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে, কখনো চাকরির প্রার্থী বা সাংবাদিক পরিচয়ে এসব ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি দেখা করতেন। নানা অজুহাতে মোবাইল ফোনে কথা বলতেন, ব্যক্তিবিশেষে যা তিন-চার মাস পর্যন্ত গড়াত। এই সময়ে স্পর্শকাতর বা গোপন কথাবার্তা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতেন নূপুর। এরপর এই তথ্য সেই ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজনদের জানিয়ে সামাজিকভাবে অপদস্থ করার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন এই নারী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর