করোনা সংক্রমণ ও এর আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় সরকারের রাজস্ব আহরণের হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অর্থবিভাগ মনে করছে, দেশের অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যেখানে করোনার প্রভাব পড়ছে না। এ জন্য আগের তৈরি পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা অনেকটা কঠিনই হতে যাচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য প্রাক্কলন ও লক্ষ্যমাত্রা নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে। আবার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার চায় কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে। এর ফলে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে একটি অসম পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে সরকার। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বাজেট মনিটরিং কমিটির সমন্বয় সভায় এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মহামারী রূপ নেওয়া করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের টার্গেট কমানো হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলন মতে, ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হচ্ছে। যা হবে জিডিপির ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে সেটা হওয়ার কথা ৪ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানায়, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি করতে হবে জিডিপির ১৫ শতাংশ। এদিকে অর্থবিভাগের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের প্রথম মাসে ১০ হাজার ২২২ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। যেখানে টার্গেট ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। তবে ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত এনবিআরের হিসাব বিবরণী মতে, নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করেছে ৮৭ হাজার ৯২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে যেসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় করার পরিকল্পনা হচ্ছে তাতে নতুন কোনো খাত নেই। আবার নতুন করে বিপুল সংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনতেও এক ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা মহামারী। কেননা করোনার অচলবস্থার কারণে দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের মধ্যে বা আগামী কয়েক বছরে নতুন করে যাদেরকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা হয়েছিল সেটাও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে আগামী বছর শুধুমাত্র এনবিআরের রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব সংগ্রহের কৌশল হিসেবে নির্ধারণ করা হচ্ছে-আয়করের আওতা বাড়ানো। ভ্যাট আইন-২০১২ এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন। এর আওতায় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কর ব্যবস্থায় কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা। সব ধরনের শুল্কফাঁকি রোধে ও বন্ড সুবিধার অব্যবহার বন্ধে বন্ডেড অ্যায়ারহাউসগুলোকে শতভাগ অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়েছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে এর প্রভাব অনেক তীব্র। ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়েও অনেক অস্বস্তি রয়েছে। কেননা যাদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে রাজস্ব পাওয়া যায় তারাও তো সমস্যায় পড়েছেন। ফলে রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন কোনো কৌশলের কথা ভাবা হচ্ছে।