জামালপুরের সরিষাবাড়ীর যমুনা নদীর তীরে এক তরুণীর গলিত লাশ ভাসছিল। দুপুরের দিকে লাশটি চোখে পড়ে গ্রামবাসীর। স্থানীয় থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। লাশটি পচে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় মেলেনি। সরিষাবাড়ী থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা করে। লাশটিকে বেওয়ারিশ হিসেবে জামালপুর পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ জুনের ঘটনা এটি। বিপত্তি বাধে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। প্রতিবেদনে বলা হয়, অজ্ঞাত ওই তরুণীকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত তৎপরতা শুরু হয়। এরপর অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ পায়। থানা পুলিশ তদন্ত করলেও তারা কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে। জামালপুরের সিআইডি কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌসুর রহমান তদন্ত শুরু করেন। সিআইডি ম্যানুয়ালের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তদন্ত চালাতে থাকে। তদন্তে নেমে সিআইডি জানতে পারে একই ধরনের একটি ঘটনায় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছিল। সেই মামলার তদন্তেও পুলিশ কিছু করতে পারেনি। যে কারণে ঘটনার পাঁচ মাস পর ৩০ নভেম্বর ফাইনাল রিপোর্ট দেয় পুলিশ। ওই মামলাটিতে বাদী ছিলেন কাজিপুরের তেকানী ইউনিয়নের পার-খুকশিয়া গ্রামের মধু শেখ। তিনি উল্লেখ করেন, তার মেয়েকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় স্বামী আমীর হোসেন ওরফে জাহাঙ্গীর ও জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়। এ মামলার ঘটনার সময়কাল সরিষাবাড়ী থানায় করা (সিআইডির তদন্তাধীন) মামলার ঘটনার কাছাকাছি সময়ে ছিল। তাই সিআইডি কর্মকর্তার ধারণা হয়, দুটি ঘটনা একই হতে পারে। কাজিপুর থানার মামলার বাদীকে অজ্ঞাত তরুণীর বাবা এবং বাদীর স্ত্রী মদিনা খাতুনকে ওই তরুণীর সম্ভাব্য পিতা-মাতা হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে তাদের সঙ্গে অজ্ঞাত তরুণীর ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচিং পরীক্ষা করান। ডিএনএ প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ীই তরুণীর প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর পুলিশ অজ্ঞাত ওই তরুণীর পরিচয় জানতে পারে। তার নাম পারুল খাতুন (২৬)। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানাধীন তেকানী ইউনিয়নের পার-খুকশিয়া গ্রামের মধু শেখের মেয়ে। সিআইডি জানায়, হত্যাকান্ডের বছর দুয়েক আগে পারুলকে বিয়ে করেছিলেন জাহাঙ্গীর। বিয়ের পর থেকেই জাহাঙ্গীর সন্দেহ করত, পারুলের পরকীয়া থাকতে পারে। এ নিয়ে দুজনের মাঝে-মধ্যেই ঝগড়া হতো। এ বিষয়ের সমাধান করতে হত্যাকান্ডের কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরের শ্বশুরবাড়িতে একটি সালিশ হয়। সালিশে জাহাঙ্গীরকে গালিগালাজ ও মারধর করা হয়। ২০১৮ সালের ১৫ জুন সন্ধ্যার দিকে তিনি ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থানার কাজলগ্রাম নৌকাঘাটে পৌঁছেন। এ সময় তাকে আনার জন্য আগে থেকে ঘাটে ছিলেন জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর তাকে বাড়ি যেতে বললে পারুল আগে বাবার বাড়ি যাবে বলে জানায়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে সন্ধ্যা ৭টার পর পারুল খাতুনকে নদীর পানিতে চুবিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে লাশ যমুনা নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। লাশ পানিতে ভেসে কাজলগ্রাম থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার ভাটায় অবস্থিত সরিষাবাড়ী থানাধীন যমুনা নদীর তীরে কুলপার চরে এসে পড়ে থাকে। ঘটনার পাঁচ দিন পর ২০ জুন এ লাশ স্থানীয়দের চোখে পড়ে। সিআইডি কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌসুর রহমান বলেন, ম্যানুয়াল তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য এবং উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় নিহতের স্বামী আমীর হোসেন ওরফে জাহাঙ্গীরকে (৩৫) আসামি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক ছিলেন। হত্যাকান্ডের পর দুই বছর তিনি এলাকায় ছিলেন না। ২০২০ সালের ২২ জুন তাকে গাজীপুর জেলার কোনাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিন জামালপুরের আদালতে দন্ডবিধির ১৬৪ ধারায় হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।