শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ইট দিয়ে বেঁধে দিলেও লাশ ডোবেনি

মির্জা মেহেদী তমাল

ইট দিয়ে বেঁধে দিলেও লাশ ডোবেনি

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কৃষক আবুল হোসেন। খুব ভোরে খেতে চলে যান কাজ করতে। সেদিন তিনি গিয়েছিলেন গরুর ঘাস কাটতে। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের ঢালু স্থানে তিনি ঘাস কাটছিলেন। ঘাস কাটতে কাটতে সামনের ব্রিজের কাছে চলে যান। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় ভাসমান একটি সুটকেসের দিকে। লাল-খয়েরি রংয়ের সুটকেসটি বেশ বড়সড়। নতুন সুটকেস ভাসতে দেখে তিনি একটু এগিয়ে যান। তার সন্দেহ হয়। ব্রিজের ওপর থেকে কোনো বাস বা গাড়ি থেকে হয়তো পড়েছে। এমন ভাবনা থেকেই মাঠে কাজে ব্যস্ত কৃষকদের তিনি ডাক দেন। তারাও এসে সুটকেসটি দেখতে থাকেন। সাত সকালে এমন একটি সুটকেসের খবর এক মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ভিড় করতে থাকে ব্রিজের নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাগেজটি নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। কেউ বলছে চোরাই মাল। পুলিশের ভয়ে হয়তো ফেলে গেছে। কেউ বলছে অসাবধানতা বশত ওপর থেকে পড়ে গেছে। নানা জনের নানা কথা বাতাসে ভাসতে থাকে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও শুনে হাজির। তারা সুটকেসটি ধরতে নিষেধ করেন উৎসুক গ্রামবাসীকে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ খবর পেয়ে ব্রিজের সামনে চলে আসে। তারা সুটকেসটি উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসে। পুলিশের সদস্যরা সেখানেই সুটকেসটি খোলার চেষ্টা করে। লোকজনের কথাবার্তায় গমগম করছিল। সুটকেসটি যখন খুলছিল তখন সবাই একদম চুপচাপ। সবার দৃষ্টি সুটকেসে। পুলিশের দুই সদস্য সুটকেসটি খুলেই আঁতকে ওঠেন। লাশ! সুটকেসের ভিতর একজন তরুণীর লাশ। উৎসুক গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক। তরুণীর হাত-পাগুলো  অস্বাভাবিক রোগা। শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তার গলায় একটি দাগ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ব্রিফকেসে ইংরেজিতে এমএসবি লেখা পাঁচটি ইটও পাওয়া গেছে। লাশটি পানির নিচে ডুবিয়ে রাখার জন্য হত্যাকারীরা এ ইট বেঁধে রেখেছিল ভিতরে। কিন্তু লাশ ডুবিয়ে রাখা যায়নি। সুটকেসটি একসময় ভেসে ওঠে। ঘটনাটি ২০২০ সালের ৯ নভেম্বরের। অপরাধীদের শনাক্ত ও লাশের পরিচয় জানার জন্য ঘটনাস্থলে আসে গোয়েন্দা পুলিশ সিআইডি ক্রাইমসিন টিম। সিআইডির এসআই তাপস কুমার দেবনাথের নেতৃত্বে লাশের আঙুলের ছাপ, অপরাধ সিনের তথ্য, ছবি সংগ্রহ করা হয়।

সুটকেসবন্দী লাশটির পরিচয় মিলছিল না কোনোভাবেই। লাশের ছবি দিয়ে ৬ হাজার পোস্টার তৈরি করে অন্তত ৪টি জেলার বিভিন্ন জায়গায় সাঁটানোও হয়। প্রযুক্তিনির্ভর নানামুখী তদন্তও চলছিল সমানতালে। এসব সত্ত্বেও লাশের পরিচয় এবং খুনি কারা জানা যাচ্ছিল না। তবে কথায় বলে, খুন কখনো চাপা থাকে না। শেষ পর্যন্ত অচিন্তনীয়ভাবে এ হত্যারহস্যও উদ্ঘাটিত হয়েছে।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। লাশের সুটকেসে হঠাৎ করেই পাওয়া যায় একটি ছোট্ট প্রেসক্রিপশন। চোখের ডাক্তার দেখানোর পর ওই প্রেসক্রিপশনটি লাগেজের এক কোনায় রাখা হয়েছিল। তবে তা ভিজলেও লেখা ছিল ঠিকঠাক। পিবিআই অন্ধকারে যেন আলো খুঁজে পেল। প্রেসক্রিপশনের সূত্র ধরেই পিবিআই অভিযান চালায় রাজধানী ঢাকায়। সেখান থেকে আবুল খায়ের মো. জাকির হোসেন ওরফে সোহাগ ও তার স্ত্রী রিফাত জেসমিন জেসিকে গ্রেফতার করে। সোহাগ ময়মনসিংহ নগরীর গঙ্গাদাস গুহ রোডের আবদুল কুদ্দুছের ছেলে। তিনি পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। হত্যাকান্ডের প্রায় তিন মাসের মাথায় লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং অভিযুক্ত গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

গ্রেফতারের পর এই দম্পতি স্বীকার করেছেন, বাসার গৃহকর্মী সাবিনাকে (২০) হত্যার পর লাশ গুম করেছেন তারা। ময়মনসিংহের আদালতে তোলা হলে হত্যার বিবরণ ও লাশ গুমের বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সোহাগ। আর জেসিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ড চেয়েছে।

পুলিশ জানতে পারে, ২০১৭ সালে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই সাবিনার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। কাজে সামান্য ত্রুটি হলেই গৃহকর্ত্রী জেসি তাকে ঠিকমতো খাবার দিতেন না। সাবিনা ক্রমেই রুগ্ন হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায়ও গৃহস্থালির কাজে কোনো ছাড় দিতেন না জেসি। যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না পরিবারের সঙ্গেও। ৮ নভেম্বর বাসায় অতিথিদের জন্য সকালের নাস্তা বানানোর কথা ছিল সাবিনার। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করায় তাকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফ্ল্যাটের স্টোররুম থেকে চটের বস্তা ও পাশের নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট থেকে ‘এমএসবি’ লেখা সংবলিত পাঁচটি ইট সংগ্রহ করেন তারা। এরপর বাসা থেকে নেন একটি মেরুন রঙের লাগেজ। প্রথমে বস্তার ভিতরে সাবিনার লাশ ঢোকান। এরপর পাঁচটি বস্তা দিয়ে সেটির মুখ বন্ধ করে দেন। পরে ইটসহ লাশটি লাগেজে ভরে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে তাদের গাড়ির পেছনের ডালায় রাখেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে গৌরীপুর থানার জোড়া ব্রিজের নিচে পানিতে সুটকেসটি ফেলে আসেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর