রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

রক্তমাখা রুমাল খুলে দেয় খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

রক্তমাখা রুমাল খুলে দেয় খুনের রহস্য

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন তলার বারান্দার এক কোনে পড়ে আছে আড়াই বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে শিশুর লাশ। লাশ ঘিরে মানুষের জটলা। লাশের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে হাসপাতালজুড়ে। ছুটে এসেছেন হাসপাতালের পরিচালক। আসে পুলিশ। কিন্তু শিশুটির কোনো দাবিদার নেই। কোথা থেকে এলো শিশুটি, কে-ই বা তাকে হত্যা করল? এমন সব প্রশ্নের জবাব কারও জানা নেই। লাশের পাশেই পড়ে আছে রক্তমাখা একটি সাদা রুমাল। শিশুটির নাক দিয়েও ঝরছিল রক্ত। বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ এক মহিলা চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে জটলার কাছে। মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই গগনবিদারি কান্না। তার কান্না দেখে সেখানে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সবাই মহিলাটিকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মহিলার আহাজারি থামানো যাচ্ছে না। ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারির ঘটনা এটি। শিশুটির নাম ইশরাত জাহান রিয়া। বাবা নুরুল ইসলাম। মা রোজিনা আক্তার। তারা ঢাকার হাজারীবাগের ৩২ নম্বর বাটানগরের বাসিন্দা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো একটি সুরক্ষিত ভবনে এভাবে একটি শিশু খুন হবে, তা যেন মাথাতেই ঢুকছিল না গোয়েন্দাদের। দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। তারা শিশুটির মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন কীভাবে ঘটল ঘটনাটি। রোজিনা বলেন, সকাল ১০টার দিকে তিনি হাসপাতালের গাইনি বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসেন। বাচ্চাটিকে বাইরে রেখে তিনি চিকিৎসকের কক্ষে ঢোকেন। তিনি বাইরে এসে দেখেন বাচ্চা নেই।’ গোয়েন্দারা কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এটা কি শিশুচোরের সিন্ডিকেটের কাজ, নাকি অন্য কারও। গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসব ভাবতে ভাবতে নিজ দফতরে ফিরে গেলেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি রক্তমাখা রুমাল আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। সেই রুমালটি রিয়ার বাবা নুরুল ইসলামকে দেখানো হলে রুমালটি আগে দেখেছে বলে জানায়। রুমালটি রিয়ার মায়ের কাছে দেখেছে বলে পুলিশকে জানায়। পুলিশের সন্দেহের তীর এখন রিয়ার মায়ের দিকে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঘটনার পর থেকে অতি উৎসাহী রোজিনা আক্তারের কিছু বিষয়ও খটকা লাগে। বিশেষ করে সে তার স্বামীকে মামলা করতে নিষেধ করতে থাকে। এতে তার ওপর সন্দেহ হয়। এরপর তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে সন্দেহভাজন ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়। পরে তাদের মোবাইল ফোনের কলরেকর্ড পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। কললিস্টে দেখা যায়, সুলতান নামে এক লোকের সঙ্গে রোজিনার নিয়মিত দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা হতো। ঘটনার দিনও রিয়া নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। কিন্তু তারপর দুজনের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। পরে কৌশলে রোজিনাকে ডিবিতে নিয়ে আসা হয়। গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসা করে, সুলতান কে? আমি চিনি না, বলে রোজিনা। এরপর গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলতে শুরু করেন- কী দরকার ছিল, কোলের শিশুটিকে হত্যা করা। কেন এ কাজ করতে গেলেন! কত জায়গায় না আপনারা ঘুরেছেন। প্রেমে মশগুল ছিলেন। নিজের সন্তানও সন্তান মনে হয়নি? এসব কথা শুনে রোজিনা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। বলেন, আমার এখন খুব খারাপ লাগছে। বুঝতে পারিনি। কী বুঝতে পারেননি? জানতে চায় গোয়েন্দা কর্মকর্তা। জবাবে রোজিনা বলেন, রিয়াকে খুনের বিষয়টা। আর প্রশ্ন করেননি না গোয়েন্দা কর্মকর্তা। পুরো বিষয়টি তার কাছে এখন পরিষ্কার। খুনের পেছনে রয়েছে নিষিদ্ধ গল্প। যে কারণে তারা খুনের মতো ঘটনা ঘটাল, তাতে কোনো লাভই তাদের হলো না। তারা এখন চার দেয়ালে বন্দী।

স্বামী-সন্তানের আড়ালে মিলিত হতো প্রেমিক সুলতানের সঙ্গে রোজিনা। এক দিন দুই দিন নয়, এভাবে বছর যায়। কাজের সময় স্বামী বাইরে থাকেন। দুই সন্তানের একজন বড় হয়েছে। অন্যজন ছোট। বিয়ে করে ঘর ছাড়বে রোজিনা। বড় সন্তানকে রেখে যেতে পারলেও ছোটটিকে কোথায় রাখবে? প্রেমিক সুলতান তাকে জানিয়ে দিয়েছে, সন্তান নিয়ে বিয়ে করবে না রোজিনাকে। কী করা যায়। শেষ পর্যন্ত প্রেমিককে পেতে কন্যাকে হত্যা করে রোজিনা। এ জন্য তিন বছরের শিশু রিয়াকে পাষন্ড মা আর তার প্রেমিক মিলে পরিকল্পনা আঁটে। প্রেমিক সুলতান মাহমুদকে নিয়ে রোজিনা তার মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা নিতে থাকে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। কোথায় খুন করা হবে, এমন নিরাপদ স্থান খুঁজতে চলে যায় পুরো দিন। অবশেষে হত্যাকান্ড ঘটানোর সম্ভাব্য স্থান একদিন পরিদর্শন করে আসেন তারা। পরদিন পূর্ব নির্ধারিত স্থানে গিয়ে খুন করে রিয়াকে। এসব শুনে রোজিনাকে নিয়ে সুলতানকে ধরে আনার অভিযান শুরু করে গোয়েন্দারা। গভীর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগলা দেলপাড়ায় পৌঁছে গোয়েন্দারা। সুলতানকে গ্রেফতার করা হয়। সুলতান সেখানে তার বড় ভাই লিটনের কাছে পালিয়ে ছিল। গ্রেফতারের পর লিটন জানায়, তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলায়। বাবা মৃত আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি হাজারীবাগ এলাকায় ছোটখাটো প্লাস্টিকের ব্যবসা করতেন। বসবাস করতেন হাজারীবাগের বাড্ডানগর এলাকায়। পাশের ৩২ বাড্ডানগর এলাকায় রোজিনারা থাকতেন। রোজিনা তাবলিগ জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত। এই সূত্রে এলাকায় এক ভাবির সঙ্গে রোজিনার সুসম্পর্ক ছিল। পরে ওই ভাবির মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয়। গোয়েন্দা পুলিশের জেরায় সুলতান পুলিশকে বলেন, পরিচয়ের পর থেকে আমাদের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময়ে রোজিনা তার স্বামীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসতেন। আমরা সাভার, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শিশুপার্ক এবং মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়েছি। মুন্সীগঞ্জে আপত্তিকর অবস্থায় ধরাও পড়েছিলাম। রোজিনা মাঝে-মধ্যেই আমার মেসে চলে আসত। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেননি মেসের অন্য সদস্যরা। এক সময় ঘর বাঁধার স্বপ্নও তৈরি হয়। রোজিনা আমাকে প্রায়ই বিয়ের জন্য চাপ দেয়। আমি ওকে বলি, কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমি অবিবাহিত ছেলে। সন্তানসহ কোনো নারীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তখন রোজিনা আমাকে বলে, সন্তান ছাড়া আসলে কি বিয়ে করবা? আমি ওকে বলি হুম, করব। রোজিনা তার ছোট মেয়েকে ঝামেলা মনে করত। সেই বলে, ওকে মেরে ফেললে সব ঝামেলাই শেষ হয়ে গেল। এরপর, আমি আর তুমি। ওর এমন কথাতে আমি রাজি হই। একপর্যায়ে হত্যার পরিকল্পনা করি। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে হত্যার ছক আঁকি। কোথায় হত্যা করা হবে? হত্যার পর লাশ কোথায় রাখা হবে? এসবই রোজিনা আমাকে দেখিয়ে দেয়। ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নাম করে টিকিট কেটে মেয়েকে বাইরে রেখে রোজিনা ডাক্তারের রুমে যায়। এ সময় আমি রিয়াকে নিউক্লিয়ার বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার সিঁড়িতে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করি। এরপর লাশ সিঁড়ির ওপর ফেলে চলে যাই।’

সর্বশেষ খবর