শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

রিকশাচালক খুলে দিল ৩২ বছরের খুনের জট

মির্জা মেহেদী তমাল

রিকশাচালক খুলে দিল ৩২ বছরের খুনের জট

মৌচাকের পাশের গলি হয়ে রিকশাটি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাচ্ছিল। স্কুলের অদূরে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলে দুজন লোক। একজন ছিলেন লম্বা, তার মুখ লম্বাকৃতির। গোঁফ ছিল পাতলা। আরেকজন ছিলেন খাটো, ভালো স্বাস্থ্যবান। মোটরসাইকেল থেকে নেমে রিকশারোহী মহিলার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেন একজন। আর বাম হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকেন। তখন রিকশারোহী মহিলা চিৎকার করে ছিনতাইকারীদের একজনের উদ্দেশ্যে বলেন, এই তোমাকে আমি

  চিনি। ছিনতাইকারী আর সময় দেননি। পিস্তল বের করেই মহিলার দিকে গুলি চালান। গুলি তার বুকের বাম পাশে লেগে বুক ভেদ করে। গুলির বিকট শব্দে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ফাঁকা গুলি করে শান্তিনগরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকেন তারা। কিন্তু ২৬ বছরের রিকশাচালক ছালাম ‘হাইজেকার, হাইজেকার’ বলে চিৎকার দিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকেন। শান্তিনগরের মহিলা সমিতির অফিসের সামনে পর্যন্ত যান। কিন্তু ততক্ষণে খুনিরা পালিয়ে যান। এরপর মহিলাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৩২ বছর আগেকার ঘটনা এটি। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন। এ ঘটনায় তার স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। রাজধানীজুড়ে শুরু হয় ছিনতাইকারী গ্রেফতার অভিযান। পাশাপাশি পুলিশও তদন্ত শুরু করে। মামলার কাগজপত্র থেকে জানা যায়, সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলার তদন্তভার পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। সগিরা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্টু নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিচারও শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ছয়জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। সাক্ষীরা তখন আদালতের কাছে মারুফ রেজা নামের এক ব্যক্তির নাম জানান। যিনি এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সাক্ষীরা জানান। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করার আবেদন করেন। আদালত তাতে সায় দেয়। বিচারিক আদালতের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে আসেন মারুফ রেজা। এরপর ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলাটি ২৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। একই বছর ১১ জুলাই হাই কোর্ট পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেয়। পিবিআই তাদের তদন্ত শুরু করে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রিকশাচালক ছালাম। রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। বর্তমানে তার বয়স ৫৬ বছর। খুনের ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ২৬ বছর। তাকে খুঁজে বের করা হয়। হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ?ঘাটন এবং খুনিদের চিহ্নিত করতে রিকশাচালক ছালাম মোল্লার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার সামনেই সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়। ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক ছালাম।

ঢাকার আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে পিবিআই বলেছে, সগিরা মোর্শেদের স্বামীর নাম আবদুস ছালাম চৌধুরী। তার বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম চৌধুরী। মেজো ভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী। তিনজনই তাদের পরিবার নিয়ে আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন।সগিরা মোর্শেদরা থাকতেন দ্বিতীয় তলায়। চিকিৎসক হাসান তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনকে নিয়ে থাকতেন ওই বাসার তৃতীয় তলায়। শাহীন তিন তলা থেকে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা ফেলতেন, যা সগিরা মোর্শেদের পেছনের রান্নাঘর ও সামনের বারান্দায় পড়ত। এ নিয়ে সগিরার সঙ্গে শাহীনের প্রায় ঝগড়াঝাঁটি হতো। আর শাশুড়ি থাকতেন সগিরার সঙ্গে। তার শাশুড়ি তাকে ভালোবাসতেন। এ নিয়ে চিকিৎসক হাসানের স্ত্রী শাহীন খুব হিংসা করতেন। ঝগড়ার সময় সগিরাকে শাহীন বলতেন, ‘দাঁড়া, আমার ভাই রেজওয়ান (আনাস মাহমুদ) আসুক। আমার ভাইকে দিয়ে তোকে মজা দেখাব। তোকে ঘর থেকে বের করব।’ পিবিআই বলছে, পারিবারিক তুচ্ছ কারণ হাসান আলী ও তার স্ত্রী শাহীনের মনে ইগোর জন্ম হয়। একসময় শাহীন সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তার স্বামী হাসানকে বলেন। হাসান তাতে রাজি হন। চিকিৎসক হাসানের রোগী ছিলেন মারুফ রেজা। যিনি তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সন্ত্রাসী ছিলেন।

সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসক হাসান। ওই কাজের জন্য মারুফকে তখন ২৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন হাসান। আর হাসান তখন মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করেন তার শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে। যাতে সগিরাকে সহজে দেখিয়ে দিতে পারেন। আনাস তার দুলাভাই হাসানের বাসায় যাতায়াত করতেন। যে কারণে তিনি সগিরাকে চিনতেন। পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, হাসান সেদিন তার শ্যালক আনাস মাহমুদকে বেলা দুইটায় ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন। মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবেন বলে জানান। হাসান তার শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরাকে দেখিয়ে দিতে বলেন। মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে করে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের গলি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢোকেন আনাস মাহমুদ। সগিরা মোর্শেদের রিকশা অনুসরণ করে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে থাকেন। মারুফ মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরার রিকশা গতিরোধ করেন। সেখানেই ঘটে খুনের এই ঘটনা।

কেন খুন হতে হলো এই নারীকে, পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে এই তথ্য। তারা বলছে, পারিবারিক ইগো ও সামাজিক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সগিরাকে হত্যা করা হয়। আর এই হত্যাকান্ডের ছক এতই নিখুঁত ছিল যে, ঘুণাক্ষরেও কারো এই হত্যা সম্পর্কে কোনো কিছু সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না। সবার সামনে এটি ছিল নিছকই ছিনতাইকারীর গুলিতে মৃত্যু।

সর্বশেষ খবর