শিরোনাম
শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হিডেন পোস্টে খুনের ক্লু

মির্জা মেহেদী তমাল

হিডেন পোস্টে খুনের ক্লু

বাবার মৃত্যুর ৪০ দিনও পার হয়নি। নিখোঁজ হয়ে গেছে পাভেল। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র আরিফুল ইসলাম পাভেল বাবার মৃত্যুর পর সংসার কীভাবে চলবে, এনিয়েই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল। ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবার পেনশনের ১২ লাখ টাকা আর আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে আরও ৬ লাখ মোট ১৮ লাখ টাকা নিয়ে এলিফেন্ট রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে যায় পাভেল। বিদায় নেওয়ার আগে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। ছেলের মাথায় হাত রেখে মা বলেছিলেন, সাবধানে থাকিস বাবা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।

রাতেই ফিরে আসার কথা বলে সেই যে গেল, আর খোঁজ নেই পাভেলের। মোবাইল ফোনও বন্ধ। স্বামীর মৃত্যুর শোক না মুছতেই ছেলের নিখোঁজে দিশাহারা হয়ে পড়েন ছোলেমা  বেগম। তার মেয়ে আনতা ইসলাম তাকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কোনো সান্ত্বনার বাণী ছোলেমা বেগমকে শান্ত করতে পারে না। নির্ঘুম রাত কাটে মা মেয়ের। খবর শুনে আত্মীয়স্বজনরা আসে। তারা খোঁজ করে পাভেলের। বাদ যায়নি থানা, হাসপাতাল এমনকি লাশ কাটার ঘরও। সবখানেই খুঁজেছে তারা। কিন্তু আশার বাণী কারও কাছে নেই। বিছানায় পড়ে যান ছোলেমা বেগম। পরিবারের শেষ সম্বল ১৮ লাখ টাকাসহ পাভেল নিখোঁজ হওয়ায় অজানা আশঙ্কা সবার মধ্যে। ঘটনাটি ২০১২ সালের ডিসেম্বরের।

ছোলেমা বেগমের মনে পড়ে পাভেলের ছোট বেলার বন্ধু জাহাঙ্গীরের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহাঙ্গীরের চলাফেরা মাস্তানদের মতো। তাকে পছন্দ করতেন না পাভেলের বাবা। ছেলেকে বলতেন, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যেন না মিশে। কিন্তু পাভেল মিশত লুকিয়ে ছাপিয়ে। মাঝে অবশ্য পাভেলের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগ একটু কমে যায়। পাভেলের বাবার মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে যোগাযোগ আবারো বাড়ে। ছোট বেলার মতোই তারা এক সঙ্গে চলাফেরা করতে থাকে।

পাভেলের মা তার মেয়ে আনতা ইসলামকে বলে জাহাঙ্গীরকে ফোন দিতে। জাহাঙ্গীরের কাছে কোনো খবর হয়তো থাকতেও পারে। আনতা ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলে জাহাঙ্গীরকে। ফোন পেয়েই জাহাঙ্গীর চলে আসে পাভেলদের বাসায়। পাভেলের মা জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞেস করেন, বাবা তোমার সঙ্গে কী পাভেলের যোগাযোগ হয়েছে? না তো খালাম্মা, কেন; পাভেল কোথায়? পাল্টা প্রশ্ন রাখে জাহাঙ্গীর। বলে, বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ফোনও দেয় না। এমন কথা শুনে পাভেলের মা বলেন, পাভেল ব্যবসার কথা বলে ১৮ লাখ টাকা নিয়েছে। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রাত থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ। খোঁজ পাচ্ছি না। এসব কথা শুনে জাহাঙ্গীর হতবাক! বলেন কি খালাম্মা!! ১৮ লাখ টাকা নিয়ে গেছে!!! এটা তো খুবই চিন্তার কথা। পাভেল আমাকেও কিছু জানায়নি তার ব্যবসার বিষয়ে। আপনাদের অবশ্যই এখন থানায় জিডি করতে হবে। চলুন আমরা থানায় যাই। কিন্তু আমতা আমতা করে ছোলেমা বেগম। তিনি আরও কিছু সময় দেখতে চান। জাহাঙ্গীর তাদের মানসিক অবস্থা দেখে সময় দেয়। সান্ত্বনা দেয়। তৃতীয় দিন পাভেলের ফোন থেকে একটি এসএমএস আসে। নিখোঁজ ভাইয়ের ফোন নম্বর দেখেই চিৎকার করে উঠে আনতা। মাকে বলে, ভাইয়ার মেসেজ আসছে। মেসেজ মায়ের উদ্দেশ্যে লেখা। ‘মা, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বিয়ে করে ফেলেছি। আমরা এখন ঢাকার বাইরে। শিগগিরই বাসায় ফিরব। চিন্তা করবেন না।’ এই মেসেজ পড়েই মা আর বোন হতাশ। মায়ের অভিমান হয়। এতগুলো টাকা নিয়ে গেছে বিয়ে করতে। জীবনের সঞ্চয় যা কিছু সবই তো পাভেল নিয়ে গেল। মা-বোনের কথা একটুও ভাবল না পাভেল! এমন কথা ভাবেন আর কাঁদেন মা। এ সময় জাহাঙ্গীর আসে বাসায়। তাকে মেসেজের কথা জানানো হয়। তখন জাহাঙ্গীর বলে, খালাম্মা আর দেরি করবেন না। থানায় চলুন। আমিও যাব। এখন জিডি করতেই হবে। থানা পুলিশকে বিষয়টি জানিয়ে রাখতেই হবে। জাহাঙ্গীর এক প্রকার জোর করেই নিউমার্কেট থানায় নিয়ে যায় পাভেলের মা আর বোনকে। পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেন ছোলেমা বেগম। এ বিষয়ে জিডি করেন তিনি। পুলিশ জাহাঙ্গীরের কাছেও পাভেলের ব্যবসা নিয়ে জানতে চায়। পরদিন আবারো পাভেলের ফোন থেকে এসএমএস আসে। আবারো একই কথা। ওই নম্বরে ফোন দেওয়া হলেই সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পাভেলের মা আর বোন আবারো পুলিশকে এসএমএসের বিষয়টি জানায়। পুলিশকে এবার ভাবিয়ে তোলে বিষয়টি। পুলিশ পাভেলের ফোনের অবস্থান তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারে। ঢাকা থেকেই এসএমএস পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এসএমএস এ বলা হচ্ছে পাভেল ঢাকার বাইরে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা মাঠে নামে। কিন্তু পাভেলের সন্ধান পায় না। পাভেল নিখোঁজে জড়িতদেরও শনাক্ত করতে পারে না। এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ পার হয়। মাসের পর মাস যায়। কিন্তু পাভেল নিখোঁজ থাকার রহস্য সুরাহা হয় না।

গোয়েন্দারা এবার নানা দিক থেকে তদন্ত শুরু করে। পাসওয়ার্ড দিয়ে পাভেলের ফেসবুক খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকে গোয়েন্দারা। একটি হিডেন পোস্টের দিকে তাদের চোখ আটকে যায়। ২৬ ডিসেম্বরের পোস্টে বলা আছে, বন্ধু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ব্যবসার জন্য নরসিংদী যাচ্ছি। দোয়া করবেন। পোস্টটি কোনো কারণে হয়তো পাবলিক করেনি পাভেল। সেই পোস্ট এখন গোয়েন্দাদের একমাত্র অবলম্বন। জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নিতে শুরু করে। এমন করতে করতেই পেরিয়ে যায় ছয় মাস। গোয়েন্দারা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে রাজধানীর রায়েরবাজার থেকে। তাকে বেশিক্ষণ জেরা করতে হয়নি। জাহাঙ্গীর প্রথমেই বলে দেয়, পাভেল আর দুনিয়াতে নেই। তাকে নরসিংদীতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেখানকার একটি কবরস্থানে লাশ পুঁতে ফেলা হয়েছে। কেন এই হত্যা, আর কারা ছিল তা মুখস্থ নামতার মতো সব বলে দেয় জাহাঙ্গীর। তার দেওয়া তথ্যে নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করে ফায়সাল এবং ফরহাদকে। কবরস্থানের একটি পাশ থেকে মাঠি খুঁড়ে বের করা হয় পাভেলের হাড়গোড়।

জাহাঙ্গীরের ভাষায়, ‘পাভেল ব্যবসা করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছিল। তাদের কাছে ১৮ লাখ টাকা আছে। কিন্তু কী ব্যবসা করবে বুঝতে পারছিল না। এ বিষয়টি আমার সঙ্গে শেয়ার করে। এ সুযোগটি আমি নেই। তাকে ব্যবসার কথা বলি। কিন্তু কী ব্যবসা করব তা তাকে প্রথমে বলিনি। আগে টাকা নিয়ে আসতে বলি। এই ব্যবসা আলাদিনের চেরাগের মতো। লাভ আর লাভ। ১৮ লাখে হবে ৩৬ লাখ। একথা শুনে লোভে পড়ে যায় পাভেল। পাভেল তার মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে টাকাটা আনতে রাজি করায়। পাভেল এক দিন ১৮ লাখ টাকা নিয়ে চলে আসে। আমি তাকে নরসিংদী নিয়ে যাই। তাকে বলি, সেখানে একজন হুজুর আছেন। হুজুর টাকা দ্বিগুণ করে দেয়। কিছুদিন আগে আমি ৫০ হাজার টাকা ১ লাখ করেছি বলে তাকে মিথ্যা বলি। পাভেলকে বলি, জিন তোর টাকা দ্বিগুণ করে দেবে। রাজি হয়েছে। পাভেল এতে খুশি হয়। আমরা নরসিংদী চলে যাই। সেখানে আমি আমার দুই বন্ধুকে আগে থেকে রেডি করে রাখি। পথিমধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সেই দুই বন্ধু পাভেলকে শুনিয়ে বলে, তারাও হুজুরের কাছে টাকা দ্বিগুণ করতে এসেছে। এক জায়গায় যখন গন্তব্য, আগে তাদের বাসায় যেতে বলে। আমি পাভেলকে বলি, ওরা আমার বন্ধু। এতে করে যখন বলছে, ওদের বাসায় কিছু খেয়ে তবেই হুজুরের কাছে যাই। আমরা ফরহাদ আর ফায়সালদের আস্তানায় যাই। সেখানে জুস পান করি। পাভেলকেও দেওয়া হয়। পাভেলের জুসে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। জুস পান করেই ঘুমিয়ে পড়ে পাভেল। আমি পাভেলের গলায় মাফলার পেঁচিয়ে ধরি। আর ফায়সাল, ফরহাদ হাত পা চেপে ধরে। সেখানেই হত্যা করি পাভেলকে। পরে পাভেলের দেহ স্থানীয় একটি কবরস্থানে নিয়ে পুঁতে রেখে চলে আসি। ফরহাদ আর ফায়সালকে ২ লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। আমি যেন সন্দেহের বাইরে থাকি, এ জন্য কয়েকদিন পর পর মেসেজ পাঠাতাম পাভেলের মোবাইল ফোন দিয়ে। পাভেলের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম।

ছেলের খুনে তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাহাঙ্গীরের জড়িত থাকার কথা জানতে পেরে ছোলেমা বেগম হতবাক। তিনি পুলিশকে বলেন, এই ছেলেই পাভেলকে উদ্ধারের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছে। জিডিও করিয়েছে এই জাহাঙ্গীর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর