শিরোনাম
রবিবার, ৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হাতের ক্ষতে খুনির সন্ধান

মির্জা মেহেদী তমাল

হাতের ক্ষতে খুনির সন্ধান

মধ্যরাতে ফোন বাজে। কয়েকবার বাজতেই ঘুম ভাঙে নয়নের। কী ব্যাপার! এত রাতে আবার কার ফোন এলো! বিরবির করতে করতে ঘুম চোখে ফোনটি হাতে নেয় নয়ন। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘কুটিলা’। নয়ন হতবাক। ভুল দেখছে নাকি! চোখ কচলে আবারও ভালো করে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। নাহ, ঠিক নামটাই দেখেছে। কুটিলার নামটি দেখেই তার চোখ থেকে এক নিমিষেই ঘুম যেন পালিয়ে গেল। শোয়া অবস্থা থেকে ধরফর করে উঠে বসে। ফোন রিসিভ করেই নয়ন বলে, কুটিলা তুমি কোথায়? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কদিন তোমাকে না দেখে আমার মন খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু এত রাতে কেন? কোনো সমস্যা নয় তো? কুটিলাকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই গড়গড় করে একাই কথা বলে যাচ্ছিল নয়ন। কথার মাঝে বাধা দিয়ে থামায় কুটিলা। বলে, আরে পাগল ছেলে, আমার কথা শুন আগে। কথা না শুনেই এত প্রশ্ন কেন করছ? নয়ন বলে, আমার খুব ভালো লাগছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। কী বলব আর কী শুনব, কিছুই বুঝতে পারছি না। কুটিলা বলে, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। অস্থির হয়ে ওঠে নয়ন। বলে, কী সারপ্রাইজ। তারাতারি বল। কুটিলা বলে, তোমাকে দেখার জন্য আমার মন ছুটে গেছে। তাইতো অনেক কৌশল করে সময় বের করেছি। আমি তোমাকে এখনই দেখতে চাই। তুমি কি আসবা একটু। এ কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে নয়ন। বলে, কী বল কুটিলা? আমি তোমার জন্যে পাগল হয়ে আছি। আর তুমি বলছ আমি আসতে পারব  কিনা? বল কোথায় আসতে হবে আমাকে। আমি এখুনি আসব। কুটিলা তাকে বলে, সামনের বাগানের পেছনের ফাঁকা ভবনটার কাছে চলে এস। নয়ন বলে, আমি আসছি রেডি হয়ে এখনই। ফোন রাখে কুটিলা।

নয়ন হাত মুখ ধুয়ে নেয়। গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। কটা দিন কুটিলাকে দেখেনি, মিশেনি। তাই মনটা তার একদম ডাল হয়ে ছিল। কুটিলার স্বামী তাদের এই গোপন সম্পর্কটা জানতে পেরে সমস্যা করছে। কুটিলাকে চোখে চোখে রাখছে। যে কারণে তারা অবাধ মেলামেশাও করতে পারছিল না। আজ এসেছে তাদের সেই সুবর্ণ সুযোগ। তাদের সেই পুরানা জায়গাতেই যেতে বলেছে কুটিলা। বাসার অদূরেই অন্ধকার বাগানের পাশের নির্মাণাধীন ভবনে তারা আগেও মিলিত হয়েছে। সেখানেই যেতে প্রস্তুত নয়ন।

কিছু সময়ের মধ্যেই অন্ধকার সেই বাগানে পৌঁছে যায় নয়ন। সেখানেই অপেক্ষায় রয়েছে কুটিলা। নয়ন কাছে যেতেই কুটিলা তার হাত ধরে। আবেগে জড়িয়ে ধরতে চায় নয়ন। বাধা দিয়ে কুটিলা বলে, এখানে না, সামনে ওই ভবনের কাছে চল। বাধ্য ছেলের মতো নয়ন কুটিলার হাতে হাত রেখে এগিয়ে যায়। ভবনে ঢুকতেই রয়েছে সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু একটি দেওয়াল। সেটির কাছে যেতেই কুটিলা মুখোমুখি দাঁড়ায়। নয়নের দুই বাহু ধরে কুটিলা। পেছনের দিকে ঠেলে দেয়াল পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাদের মুখে কোনো ভাষা নেই। তাকিয়ে একজন আরেকজনের দিকে। নয়ন তখন কিছু একটা বলতে চায়। বলতে পারে না। কুটিলার হাত তখন নয়নের মুখে ছুঁয়ে দেয়। চোখ বন্ধ হয়ে আসে নয়নের। ঠিক সেই মুহূর্তে দেয়ালের ওপাশ থেকে ছুড়ে দেওয়া হয় একটি নাইলনের দড়ি। যার সামনে ফাঁস লাাগানোর মতো করে একটি গিট্টু দেওয়া রয়েছে। দড়ির অপর প্রান্ত থাকে দেয়ালের ওপাশেই। ছুড়ে দেওয়া দড়ির মাথা মুহূর্তেই ধরে নেয় কুটিলা। সময় নষ্ট করে না। গোল করে গিট্টু দিয়ে বাঁধা দড়ির অংশটি নয়নের মাথা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয় কুটিলা। নয়ন কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেওয়ালের ওপাশ থেকে দড়ি ধরে টান দেওয়া হয়। দড়িটি নয়নের গলায় বসে যায়। ফাঁস লাগে। ঘুরে যায় নয়ন। ছটফট করতে থাকে। দড়িতে হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করতে থাকে নয়ন। কিন্তু কুটিলা হাত ধরে রাখে। বাধা দেয়। দেওয়ালের ওপাশে থাকা লোকটি ছিলেন কুটিলার স্বামী জহুর আলী। তিনি দড়ি ধরে টানতে টানতে দেওয়ালের ওপর উঠে পড়ে। দেওয়ালে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে দড়ি টানতে থাকে। নয়নের চোখ বড় হয়ে আসে। যেন বেরিয়ে পড়বে। ছটফট করতে থাকে। নয়নের মাথায় ছিল একটি গামছা। সেটি নিয়ে নয়নের মুখে ঢুকিয়ে দেয় কুটিলা। যতক্ষণ পর্যন্ত শ্বাস ছিল নয়নের, ততক্ষণ স্বামী-স্ত্রী মিলে গলার ফাঁস টেনেই ধরে রাখে। নয়নের মৃত্যু হওয়ার পর জহুর আলী তার স্ত্রী কুটিলাকে নিয়ে বাড়ি চলে যান। ঘটনাটি যশোর বেনাপোলের পোর্ট থানা এলাকার। গত বছরের ডিসেম্বরে। সাত সকালেই এনজিও কর্মী আল আমিন নয়নের লাশ চোখে পড়ে গ্রামবাসীর। তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এ বিষয়ে পোর্ট থানা বেনাপোলে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ নিশ্চিত, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তের একপর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে নয়নের সঙ্গে কুটিলা নামে এক নারীর পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি নিয়ে কুটিলার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এমন তথ্য পেয়ে নজরদারি শুরু করে পুলিশ। কুটিলা এবং জহুর আলীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। পুলিশের কাছে খবর আসে, জবুর আলীর হাতে একটু যখমের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ আর অপেক্ষা করেনি। জহুর আলীকে আটক করে জেরা করতে থাকে। জহুর আলী বলে দেয় নয়ন খুনের ঘটনা। জহুর আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন নুরুন্নাহার কুটিলা। বেনাপোলের দুর্গাপুরে তাদের বাড়ি। কুটিলার সঙ্গে সম্পর্ক হয় এনজিও কর্মী নয়নের। কুটিলা ও নয়নের পরকীয়া সম্পর্কের কথা এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। কুটিলাও এ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিল। বাধ্য হয়ে তারা নিজের বাড়ি ছেড়ে জহুর আলী স্ত্রীকে নিয়ে গ্যারেজে চলে যায়। সেখানেই তারা থাকেন। কিন্তু নয়ন সেখানে গিয়েও কুটিলার সঙ্গে সম্পর্ক করে। বিষয়টি জেনে যায় জহুর আলী। জহুর আলী তার স্ত্রীকে বুঝায়। তার বড় ঘরের সন্তানরা মাদরাসায় লেখাপড়া করে। এ অবস্থায় নয়নকে হত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কুটিলা তার স্বামীর কথায় রাজি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ ডিসেম্বর রাতে নয়নকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বাড়ির পাশে গলায় রশি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। গত এপ্রিলে এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, পরকীয়ায় জড়িয়ে দুটি পরিবার আজ তছনছ হয়ে গেছে। এক পরিবার থেকে চলে গেছে দুনিয়া ছেড়ে। আরেক পরিবারের দুজন এখন জেল হাজতে। ক্লুলেস এই খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয় খুনির হাতের ক্ষত চিহ্ন দেখেই।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর