শিরোনাম
সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

কুকুর দিল খুনির সন্ধান

মির্জা মেহেদী তমাল

কুকুর দিল খুনির সন্ধান

ঘটনা ১০ মার্চ ২০১৩। রাজশাহীর দুর্গাপুরের আমগাছি গ্রাম। ছোট্ট একটি খোলা জায়গা। যার তিন দিকে ছোট করে দেয়াল ঘেরা। ফাঁকা জায়গাটি চলাচলের রাস্তার পাশেই। সাতসকালে লোকজনের চোখে পড়ে গলা কাটা একজন পুরুষের লাশ। দেয়ালঘেরা সেই ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় লাশটি পড়ে আছে। মাথা নেই। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের পর পুলিশ প্রায় নিশ্চিত, অন্য কোথাও হত্যার পর লাশ ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ জানতে পারে, লাশটি স্থানীয় একজন ভ্যানচালক আবদুল মান্নানের। মান্নানের পরিবার পরনের কাপড় দেখে তাকে শনাক্ত করে। গ্রামবাসীর মুখে মুখে তখন একটি কথা, গ্রামে গলা কাটা বাহিনী ঢুকেছে। এ নিয়ে গ্রামে আতঙ্ক। তারা এনিয়ে কোনো কথাও বলে না ভয়ে। সন্ধ্যায় লোকজনের চলাফেরা কমে যায়। হাট-বাজারও বন্ধ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। পুলিশ আবদুল মান্নানের বিচ্ছিন্ন মাথার সন্ধান শুরু করে। পাশাপাশি চলে তদন্ত।

এমনই যখন এক পরিস্থিতি একই এলাকায় মিলে আরেকটি লাশ। ভ্যানচালক মান্নানের লাশ উদ্ধারের ৩৫ দিন পর আরেকটি মাথা ছাড়া নিথর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের পরিচয় মিলে সেই দিনই। আগের রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন সাবেক মেম্বার কাউয়ুম। কাইয়ুমের ছেলে লাশটি তার বাবার বলে শনাক্ত করে। রাতে বাসা থেকে কাইয়ুম বাজারের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়। চা খেয়েই ফিরে আসবে বলে জানিয়ে যায়। কিন্তু কাইয়ুমের বৃদ্ধ বাবা বারবার তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। শুনেননি কাইয়ুম। রাতে ফেরেননি বাসায়। সকালে তার মাথা ছাড়া লাশ মেলে।

ছোট্ট একটি গ্রামে অল্প সময়ের ব্যবধানে                পর পর দুটি লাশ উদ্ধারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলে পুলিশ প্রশাসনকে। দুটি লাশের মাথা খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের ধারণা, খুন দুটির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লোক জড়িত রয়েছে।

তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, কাইয়ুম ঘর তৈরি করার টাকা পেতেন স্থানীয় সিরাজের কাছে। টাকা চাইতে গেলে সিরাজ লোকজন নিয়ে তাকে মারধর করে। পুলিশের সন্দেহ হয়, টাকার জন্যই সিরাজ এই খুন করতে পারে। পুলিশ এ খবর জানতে পেরেই হানা দেয় সিরাজের বাড়িতে। পুলিশ সিরাজের বাড়ির উঠানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ খুঁজে পায়। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যায় সিরাজ। কিন্তু পুলিশ বাসার ভিতরে খুঁজে পায় সিরাজের স্ত্রী ফিরোজা বেগমকে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় থানায়। কিন্তু তার কাছ থেকে পুলিশ কোনো তথ্য পায় না। পুলিশ হানা দেয় একই গ্রামে ফিরোজা বেগমের বাবা তরফদারের বাড়িতে। পুলিশ তরফদারকে থানায় নিয়ে যায়। তাকে কাইয়ুমের বিচ্ছিন্ন মাথাটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তা জানতে চায়। কিন্তু তরফদারও কিছু বলতে পারেন না। পুলিশের এখন প্রধান কাজ, বিচ্ছিন্ন মাথার সন্ধান করা।

১৮ এপ্রিল। স্থানীয় একটি মাঠে ছোট ছেলেরা খেলা করছিল। মাঠের পাশেই রফিকুলের বাড়ির পেছনে ঝোপের কাছে একটি কুকুর খামছে খামছে মাটি তুলছিল। ছোট ছেলেদের চোখে পড়ে তা। তারা সামনে এসে দেখে কুকুরটি খামছে মাটি তুলছে। আর এই কুকুরটি হলো কাইয়ুমের পোষা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন আসে। তারাও এ দৃশ্য দেখতে পায়। ছুটে আসে কাইয়ুমের ছেলেও। লোকজন কৌতূহল বশত ওই স্থানে কোদাল চালায়। মাটি খুঁড়তে থাকে। এক ফুট মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে কাইয়ুমের বিচ্ছিন্ন মাথা। পুলিশ আসে। মাথাটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পুলিশ খোঁজ করে রফিকুলের। কিন্তু রফিকুল নেই। পুলিশ দেখেই লাপাত্তা বনে গেছে। পুলিশের তদন্তে চলে আসে নতুন আরেকটি নাম। রফিকুল কেন পালিয়ে গেল? তবে কী এই খুনের সঙ্গে রফিকুল জড়িত? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে মাঠে নামে পুলিশ।

পুলিশ যখন দুটি খুনের তদন্ত নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখনই একটি ফোন কল আসে দুর্গাপুর থানার এক কর্মকর্তার কাছে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করে পুলিশের কাছে কিছু তথ্য দেয়। পুলিশ সেই তথ্য পেয়ে খুনের সূত্র খুঁজে পায়। তথ্য পেয়ে পুলিশ হানা দেয় একটি মেসে। সেখান থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে রফিকুলকে। রফিকুলকে পুলিশ জেরা করে। সে খুনের বিষয়ে কিছুই জানে না বলে বলতে থাকে। রফিকুল বলে, এসব খুন করেছে গলা কাটা বাহিনী। তাদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ যখন তাকে রিমান্ডে নেয় তখন আর মিথ্যা কথা বলতে পারেনি রফিকুল। সে স্বীকার করে নেয় খুনের ঘটনাটি। কেন খুন করেছে, সেটিও বলে দেয় পুলিশের কাছে।

সিরাজের স্ত্রী ফিরোজার সঙ্গে কাইয়ুমের ছিল অবৈধ সম্পর্ক। রফিকও সম্পর্ক তৈরি করে ফিরোজার সঙ্গে। এ নিয়ে দুজনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। রফিকুল চায় শুধু তার সঙ্গেই সম্পর্ক থাকবে ফিরোজার। এ কারণে কাইয়ুমকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে  দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে। এক রাতে রফিকের পরিকল্পনা মতো ফিরোজা ফোন দেয় কাইয়ুমকে। ফিরোজার ফোন পেয়ে কাইয়ুম ছুটে যায় ফিরোজার বাসায়। ফিরোজার ঘরে ঢুকতেই পেছন থেকে আঘাত করে রফিক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাইয়ুম। এরপর তাকে জবাই করে। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। লাশ বস্তায় ভরে ফেলে রাখে অন্য স্থানে। মাথা পুঁতে রাখে মাটির নিচে।

পুলিশ জানতে পারে, কিছুদিন আগে ভ্যানচালকের মাথাবিহীন লাশ পাওয়া যায়। মাথাটি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ওই ঘটনার পেছনে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। যে কারণে মাথাটিও আর পাওয়া যায়নি। রফিক সেই বিষয়টি মাথায় নেয়। মাথা সরিয়ে ফেললে হয়তো সবার ধারণা হবে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হাতেই খুন হয়েছে কাইয়ুম।

পুলিশ গ্রেফতার করে রফিক ও তার প্রেমিকা ফিরোজাকে।  যেহেতু খুনের ঘটনাটি সিরাজের বাসায় ঘটেছে, পুলিশের সন্দেহ ছিল সে হয়তো জড়িত। কিন্তু পুলিশ দেখেই পালিয়ে যায় সিরাজ।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর